আষাড়-শ্রাবণে বষার ভরা মৌসুমেও কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি নেই। ঈশ্বরদীতে এবার যেন চলছে অনাবৃষ্টির কাল। শ্রাবণের শেষ দিন রোববার সামান্য বৃষ্টি হলেও তাতে ধানের চারা রোপণের জন্য দরকারি কাদামাটি তৈরি দূরের কথা, জমি ভেজেইনি ঠিকমতো। এদিকে চলে এসেছে ভাদ্র মাস। এতে আমন আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এখানকার চাষিরা।
কম বৃষ্টির হতাশা এড়িয়ে অবশেষে পানি সেচ দিয়ে জমি তৈরি করে কৃষকরা আমন ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিন্তু এতে যোগ হয়েছে বাড়তি খরচের চিন্তা। বেশিরভাগ কৃষকেরই সেচের পানি দিয়ে আমন আবাদ শুরু করেই বাজারে জ্বালানি তেল, সার, জমি চাষ ও শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ঈশ্বরদী এলাকার কৃষকরা। তাই উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় অনেক কৃষক এবার আমন চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়েছেন। ভরা বর্ষা মৌসুমেরও এবার প্রত্যাশিত বৃষ্টি হয় নি। বিগত ৪২ বছরের মধ্যে আষাঢ়- শ্রাবণ মাসে এতো কম বৃষ্টিপাত হয়নি বলে ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
আবহাওয়া অফিস আরও জানায়, ২০২১ সালে জুন-জুলাই মাসে ঈশ্বরদীতে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১১.৭৫ মিলিমিটার। আর ২০২২ সালে দুই মাসে গড় বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ২.৫৫ মিলিমিটার। অর্থাৎ শতকরা হিসেবে গত বছরের তুলনায় এবারে ৭৮.৩০ভাগ কম বৃষ্টি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ আগষ্ট) সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, ভাদ্র মাস চলে আসায় সেচ দিয়েই অবশেষে কৃষকরা ধানের চারা রোপণ করছেন। কেউ ধানের চারা তুলছেন, কেউ চারা রোপণ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে- এবার ঈশ্বরদী উপজেলায় আমন ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৭ শত ৮০ হেক্টর জমিতে। সে অনুযায়ী এখন আমন ধান আবাদের শেষ সময় চলছে। তবে সার ও ডিজেল, লাঙ্গল ও শ্রমিকের দাম বাড়ার কারণে কৃষকদের মধ্যে ধান চাষাবাদে খুব বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক জমিতে এখন পর্যন্ত ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ জানায়। তবে জ্বালানি, সার,সেচ,লাঙ্গল ও শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি এবার পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়াকেও এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি এলাকার কৃষক আনসার আলী নিজের জমি চাষাবাদের পাশাপাশি তিনি স্থানীয় কৃষকদের জমিও তার ট্রাক্টর দিয়ে চুক্তিতে চাষ করে দিতেন। তবে এবার হঠাৎ করেই তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে তিনি বিপদে পড়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের চাষাবাদের অবস্থা খুব খারাপ, বিশেষ করে এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় জমি তেমন একটা চাষের উপযোগী হয়নি। এর পর নতুন করে তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ৩৪ টাকা। মৌসুম শুরুর দিকেই অনেক কৃষকের সঙ্গে চুক্তি করেছি প্রতি একর জমি চার হাজার টাকায় চাষ করে দেবো। কিন্তু এখন তেলের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে এই টাকায় চাষ দেওয়া সম্ভব নয়। এখন জমি চাষাবাদ বাদ দিয়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
এদিকে, ডিজেলের ও সারের মূল্য বৃদ্ধির গোপালপুরের কৃষক আন্টু নিজের জমি আবাদের পাশাপাশি পাওয়ার টলি দিয়ে আন্যের জমি চাষ দেন। তিনি জানান, জ্বালানি তেলের দাম বাড়াই বিঘা প্রতি জমি এক চাষ দিয়ে ৪৫০ টাক নিচ্ছেন।আগে ছিল ৩৫০ টাকা। সার,সেচ শ্রমিক ও লাঙ্গল, পাওয়ার টলি দিয়ে চাষের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এই অঞ্চলের কৃষকরা।
এখন সেচ দিয়ে আমন রোপণ করবেন কি না, দ্বিধায় আছেন কৃষক ইসলাম আলী । বললেন, ‘লোকসানের ভয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না আমন ধান লাগানোর।’
উপজেলার সাড়া ইউনিয়নের গোপালপুর এলাকার কৃষক আব্দুস সামাদ বলেন, ‘সারের দাম বাড়তি, তেলের দাম বাড়তি। এখন কেমনে কী করমু। জমি আল্লাহর ওয়াস্তে ফালাইয়া রাখছি। চাষ দিচ্ছি না। কোনোভাবেই পোষাইতে পারছি না।
কৃষক সাদ্দার আলী বলেন, আগে কৃষককে প্রতি কেজি ইউরিয়া কিনতে হতো ১৬ টাকায়, এখন কিনতে হবে ২২ টাকায়। এমওপি,টিএসপি, ডেপ সার সরকার নিধারিত দামে পাওয়া যাচ্ছে না। এক বিঘা জমি গরুর লাঙ্গল দিয়ে চাষ করতে ৩৫০ টাকা ছিল, কিন্ত গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় এখন নিচ্চে ৫০০ টাকা।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঈশ্বরদী পৌর এলাকাসহ উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে চলতি বছর খরিপ-২ রোপা আমন উফশী জাতের ধান আবাদ হচ্ছে। শ্রাবণের শুরুতে এ জাতের ধান রোপণের মৌসুম। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় সবাই রোপণ করতে পারেননি।
উপজেলা কৃষি অফিসার মিতা সরকার জানান, তাদের দেওয়া ধানের জাতগুলো হচ্ছে- উপসী রোপা আমন ব্রি-ধাণ-৮৭, ৮০, ৭৫ ও বিনা-১৭। এসব আধুনিক আমন ধান চাষ করে সেচ ছাড়া ও কম সার ব্যবহার করে বাম্পার ফলন পাওয়া সম্ভব। এছাড়া কৃষকদের পরামর্শ দিতে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। আর সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারলে বিঘা প্রতি ৩০ মন পর্যন্ত ধানের ফলন পাওয়া সম্ভব। এছাড়া জালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করায় কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় কিছুটা বাড়বে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে সরকার উদ্যোগ নিলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।