ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যুক্তরাজ্য পেরিয়ে জিল্লুরের সামাজিক কাজের ছোঁয়া বাংলাদেশে

যুক্তরাজ্য পেরিয়ে জিল্লুরের সামাজিক কাজের ছোঁয়া বাংলাদেশে

নব্বইয়ের দশকে বাবার হাত ধরে যুক্তরাজ্য পাড়ি জমান বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের কিশোর জিল্লুর হোসাইন। তারপর বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা সেখানেই। পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই যুবক জিল্লুর ধরলেন বাবার ব্যবসায়ের হাল। খুব দ্রুত নতুন করে সাফল্যের দেখা পেলেন জিল্লুর। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল মানুষের জন্য কিছু করার। সেই চিন্তা থেকে ২০১২ যুক্তরাজ্যে যাত্রা শুরু করেন জাই ফাউন্ডেশন।

গত এক যুগে নানামুখী কর্মকাণ্ডে জাই ফাউন্ডেশন হয়ে ওঠেছে যুক্তরাজ্যের মানুষের অত্যন্ত প্রিয় নাম। আর সেই জাই ফাউন্ডেশনেরই আরেকটি উদ্যোগ এসএমআর এবার চালু হচ্ছে বাংলাদেশে। মূলত মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক সমস্যা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে বৈশ্বিকভাবে কাজ করে এসএমআর।

বাংলাদেশে এই প্রতিষ্ঠানের একটি কলসেন্টার স্থাপন ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য এরিমধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিশ্বেও বিভিন্ন স্থানের গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্স পার্সনদের দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হবে এই কলসেন্টারের কর্মী। মাল্টিলেঙ্গুয়াল এই কলসেন্টার প্রথমে ইংল্যান্ডে বসবাসরত বাঙালি ও ইংল্যান্ডের নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সেবা প্রদান করবে।

মূলত নিঃসঙ্গ, ডিপ্রেশনে থাকা আত্মহত্যা-প্রবণ মানুষদের নিয়ে এই সংগঠনের কাজ। পর্যায়ক্রমে এর কাজ বাংলাদেশেও চালু হবে বলে জানান এইসব সামাজিক কার্যক্রমের মূল উদ্যোক্তা জাই ফাউন্ডেশন ও এসএমআর’র প্রতিষ্ঠাতা জিল্লুর হোসাইন।

লন্ডনে এই সেবা চালু হলেও এখন বৈশ্বিকভাবে এটি ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। জিল্লুর হোসাইন জানান, এতদিন ইংল্যান্ড নানাভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে। এবার আমরা চাচ্ছি এখানকার জনশক্তি ব্যবহার করে ইংল্যান্ডের মানুষদের সেবা দিতে। এটা সম্ভব হলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনেক বড় একটি অর্জন হবে। শুধু তাই নয়, এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা যেমন বাংলাদেশের জন্য বড় সম্পদ হয়ে ওঠতে পারবেন, ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এই প্রশিক্ষিতদের দেশের বাইরেই রপ্তানি সম্ভব বলে জানান জিল্লুর হোসাইন।

এসএমআর’র মূল উদ্যোক্তা জাই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম শুরু করে ২০১২ সালে। এরপর যুক্তরাজ্যেও স্কুল ও হাসপাতালগুলোতে নানামুখী সেবা প্রদান শুরু করে এই অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি।

কল সেন্টার বলতে মেন্টাল সার্ভিসের জন্য ফোন কল করে সুবিধা নেওয়া নাকি অন্য কিছু? এই ব্যাখ্যায় জিল্লুর হোসাইন বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা কমবেশি প্রতিটি মানুষের মধ্যেই থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কারও হাত ভাঙে তাহলে সেটা দেখা যায়। কিন্তু দেহের ভেতরের যে অংশ আক্রান্ত হয়, সেটা দেখানো সম্ভব হয় না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ মানুষ মেন্টাল হেলথ নিয়ে সমস্যায় ভোগেন। আপনি যদি তাদের কথার মাধ্যমে ভালো রাখতে পারেন তাহলে তারা শান্ত হবে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।

‘অবাক করা তথ্য হলো, বিশ্বে মাত্র ৪ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করছে। এই আত্মহত্যা মেন্টাল হেলথের কারণেই হয়ে থাকে। কেউ যদি মনে করেন হতাশা, অবসাদগ্রস্ত, অসুখী এবং তার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনও আগ্রহ নেই- সেসব মানুষদের জন্যই এ উদ্যোগ। মানুষ এখন এত ব্যস্ত যে কারও সাথে কথা বলার সময় নেই। যে মানুষটি হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল, সে হয়তো কারও সাথে একটু কথা বলতে পারলেই এমন আত্মাহুতির পথ বেছে নিতো না। আমাদের কল সেন্টার এমন মানুষের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে। আমাদের কর্মীরা জানে, কীভাবে মানুষকে ট্রিট করে বিপদগামী পথ থেকে ফিরিয়ে আনা যাবে। ইংল্যান্ডে আমাদের কোম্পানির সাথে ন্যাশনাল হেল্প লাইন নম্বরের যোগাযোগ আছে। পুলিশের সাথে আছে, হাসপাতালগুলোর সাথে আছে। তারা যদি মনে করে রোগীটা বেশি খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে! তাকে আমাদের কাস্টমার নম্বরে ফোন করে সমস্যা শেয়ার করতে পারে।’

প্রতিষ্ঠানের মূল ফান্ডিং জিল্লুর হোসাইনের পারিবারিক ব্যবসার সিএসআর ফান্ড থেকে আসলেও ইংল্যান্ডের বিত্তশালীরা এখন এগিয়ে আসছেন। সবার সহযোগিতা নিয়ে জিল্লুর তার সেবাটি ছড়িয়ে দিতে চান সারা বিশ্বে। আর সৎভাবে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করলে সরকারি ফান্ড পেতেও বেগ পেতে হবে না বলে জানান তিনি।

এসএমআর’র এই উদ্যোগে বাংলাদেশ কীভাবে উপকৃত হবে? এমন প্রশ্নে জিল্লুর হোসাইন বলেন, যাদের আমরা ট্রেনিং দিচ্ছি, যেমন- নার্সের ট্রেনিং শেষে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্সসহ অনেক দেশে বাংলাদেশের নার্স কাজের সুযোগ পাচ্ছে। ভবিষ্যতে যদি তাদের নার্সের প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত নার্সদের সহজে যোগ দিতে পারবে। নতুন কাউকে কাজে যোগ দিতে অন্তত ছয় মাস সময় লেগে যাবে। আমাদের ট্রেনিং-প্রাপ্তরা সেখানে দ্রুত কর্মসংস্থানে যোগ দিতে পারবে।

এক্ষেত্রে ভাষা কোনও অন্তরায় হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রথমত ১ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি ইংল্যান্ডে বসবাস করে। আমাদের বাংলাদেশি অনেকেই হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারে। যা ভাষাগত সমস্যা দূর করবে সহজেই। ইংলিশরাও এসব ভাষায় আজকাল অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাছাড়া আমাদের কলসেন্টারটি মাল্টিল্যাঙ্গুয়াল হবে।

জিল্লুর হোসাইন একজন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী হিসেবে যুক্তরাজ্যে নিজের স্বকীয় অবস্থান তৈরি করেছেন। ২০২০ সালের রাজ পরিবার কর্তৃক প্রদত্ত এমবিই পুরস্কার রয়েছে তার সংগঠনের। করোনাকালে তার ও তার সংগঠনের কার্যক্রম গোটা যুক্তরাজ্যে প্রশংসিত হয়েছে। করোনা মহামারিকালে দুটি শহরে প্রায় ৭৫ হাজার মানুষের যাবতীয় ট্রয়লেটিজ আইটেম, পানীয় এবং খাবার অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে সহায়তা করেছে জাই ফাউন্ডেশন। মূলত এর স্বীকৃতি হিসেবেই ব্রিটেনের রয়েল ফ্যামিলির পক্ষ হতে এমবিই পদক দেওয়া হয়েছে তাদের। লন্ডনের যে শিশুরা পড়াশোনার ফি দিতে পারে না, জিল্লুরের সংগঠন তাদের টিউশন ফি পরিশোধ করে। এ ছাড়া যেসব শিশু স্কুলে লাঞ্চ নিয়ে আসতে পারে না, তাদের খাদ্য সহায়তা করে।

সুনামগঞ্জের জিল্লুর হোসাইনের ইংল্যান্ডযাত্রা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৯১ সাল থেকেই আমি লন্ডনে বসবাস করছি। ১৪ বছর বয়সে আমি লন্ডনে গিয়েছি। পড়াশোনা কিছু এখানে, বাকিটা করেছি লন্ডনে। ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত আমি সুনামগঞ্জ জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা- হোটেলের ব্যবসা। আমি যখন সাউদাম্পটন যেতাম, বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। আমি ওনার সাথে কাজ করেছি। আমার বয়স যখন ১৮ হয়, বাবা দেশে চলে আসে। তখন থেকে আমি ব্যবসায়ের সাথে সম্পৃক্ত। বর্তমানে আমাদের দুটি হোটেল রয়েছে ক্যামব্রিজে।

এসএমআর’র পাশাপাশি জিল্লুর শুরু করেছেন একাধিক ওইমেন্ এমপাওয়ারম্যান্ট ও পোভার্টি এলিমেশন প্রজেক্ট। যে প্রজেক্টগুলোতে বাংলাদেশি একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জড়িত। জিল্লুরের বিশ্বাস ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত আধুনিক বাংলাদেশের যে স্বপ্ন মানুষ দেখছে, তার উদ্যোগগুলো সে স্বপ্ন পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

দারিদ্র্য
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত