দুইবারের এমপির শেষজীবন কেটেছে আবাসনে
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ২১:৩২ | অনলাইন সংস্করণ
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
ময়মনসিংহ-৮ (গফরগাঁও) আসনের সাবেক দুইবারের সংসদ সদস্য এনামুল হক জজ মিয়ার শেষ জীবন কেটেছে সরকারি আবাসনের ঘরে। মৃত্যুর আগে তাঁর ভাগ্যে জুটেনি ঔষধ ও খাবার কেনার টাকাও। ফলে মৃত্যুর আগে ছোট বড় পরিচিতজন যাকেই সমানে পেতেন তিনি তার কাছেই টাকা চাইতেন। অনেক সময় ঘরে খাবার থাকত না। তখন পাশের বাড়ীর লোজনের কাছেও তিনি খাবার চাইতেন। কেউ দিত, কেউ দিত না। আবাসনের প্রায় সবার জীবনই কষ্টের। তাই তাদের মন চাইলেও দিতে পারত না। এসব দেখে মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হত আমার। রাগ করে বঝাঝকা করতাম। তবে সব শুনে চুপ হয়ে থাকতেন তিনি।
এভাবেই কান্নাজড়িত কন্ঠে গত (১৩ জানুয়ারি) রাতে সদ্য প্রয়াত দুইবারের সংসদ সদস্য এনামুল হক জজ মিয়ার জীবনের নির্মম দুঃখ গল্প তুলে ধরেন তাঁর শেষজীবনের নিত্য সঙ্গি স্ত্রী রুমা হক।
এর আগে গত ১১ জানুয়ারি উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের প্রায় এক বছর ধরে বসবাস করা সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে তাঁর মৃত্যু হয়।
তবে মৃত্যু আগে তাঁর পূর্বের স্ত্রী ও সন্তানরা কেউ দেখতে আসেনি বা খোঁজ রাখেনি। এমনকি মৃত্যুর পরও খবর শুনেও তারা কেউ দফান করতেও আসেনি বলে জানান রুমা হক।
তিনি বলেন, জজ মিয়া অনেক ভালো মনের উদার মানুষ ছিলেন। প্রায় ১২ বছর আগে জজ মিয়ার সংসারে আসি আমি। সংসারে প্রথম দিকে বুঝতাম অনেক দুঃখ ছিল তাঁর মনে। কিন্তু কেন তার জীবনে এমন পরিণতি বা কষ্ট তা বলেননি কোন দিন। দুই বার এমপি হয়ে এলাকার অনেক মানুষের উপকার করেছেন। শুনেছি তাঁর কাছে এসে কেউ নিরাশ হয়ে ফিরে যায়নি। জীবনে ব্যাপক ধনসম্পদ তার না থাকলেও চলার মত জমি-সম্পত্তি ছিল এলাকায়। কিন্তু জীবনের শেষদিক অনেক কষ্টে কেটেছে তাঁর। একজন এমপির জীবনে এত কষ্ট ? ভেবে পাই না আমি, বলেও যোগ করেন তিনি।
এ সময় আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, শুনেছি গ্রামের অনেক জমি সম্পত্তি বিক্রি করে আর হাতে জমানো টাকায় ঢাকা শহরের কাজীপাড় এলাকায় দুইটি পাঁচতলা বাড়ী করেছিলেন। ওই বাড়ীতেই এমপি সাব স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে থাকতেন। কিন্তু তাদের সংসারে পুত্র সন্তান না থাকায় মৃত্যুর পর ওই সম্পত্তিতে ভাই-ভাতিজারা অংশিদার হয়ে যেতে পারে, এমন ভয় থেকে তাঁর আগের স্ত্রী-মেয়েরা এমপি সাবকে (জজ মিয়া) ভুল বুঝিয়ে ওই বাড়ী দুইটি লিখে নিয়েছে। এর কিছুদিন পর এমপি সাবকে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেয় তারা। কিন্তু লজ্জায় ঘটনাটি তিনি প্রকাশ না করলেও পরে সবই জানাজানি হয়।
ওই ঘটনার পর তিনি অসহায় হয়ে ঢাকা থেকে এলাকায় ফিরে এসে পৌর শহরের বাসায় উঠেন। কিন্তু ১২ লক্ষ টাকা সুদ ঋণ থাকায় অবশেষে সেই বাড়ীটিও তিনি স্থানীয় এক বিএনপি নেতাকে লিখে দিয়ে উঠেন ভাড়া বাসায়। এরপর গ্রামের অবশিষ্ট যে জমি ছিল তা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে পড়লে সর্বশেষ জজ মিয়ার শেষ আশ্রয় হয় সরকারি আবাসন প্রকল্পের ঘরে। গত ১১ জানুয়ারি সে ঘরেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের সব প্লানি মুছে চিরদিনের মুক্তি নিয়ে নির্মম পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি জমান অসীম পরপারে।
সূত্র জানায়, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের পালিত মেয়েকে বিয়ে করে জাতীয় পার্টী থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এনামুল হক জজ মিয়া। তখন টানা ৯ বছর দাপুটে এমপি থাকা অবস্থায় তাঁর বাবার দেওয়া জমিতে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, গফরগাঁও সরকারি কলেজ, খাইরুল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় সরকারকিরণসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন সাংসদ জজ মিয়া। এছাড়াও বিনা পয়সায় এলাকার অনেক মানুষের চাকরি দিয়েছেন তিনি।
স্থানীয়রা জানায়, উপজেলার একটি বংশীয় পরিবারের সন্তান জজ মিয়া। তাঁর বাবা সুনামধন্য স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তাছাড়া জজ মিয়ার ভাই-ভাতিজারা সবাই বিত্তবান। ভালো ভালো কর্মক্ষেত্রে তারা প্রতিষ্ঠিত। অথচ এক সময় জজ মিয়া তাদের সবার কাছেই পরিবারের ‘আলোকিত’ মানুষ থাকলেও শেষ জীবনের দুঃখকষ্টে কেউ পাশে দাড়াঁয়নি তাঁর। কিন্তু কেন বা কি ক্ষোভে তারা এমন করেছে, এর কারণ জানা নেই। তবে জজ মিয়ার শেষ জীবনের এই করুণ পরিণতিতে ব্যথিত এলাকার সাধারণ মানুষ।
স্ত্রী রুমা হক আর জানান, এরপর প্রায় ১২ বছর আগে এমপি সাবের সাথে আমার বিয়ে হয়। তখন থেকেই কোন রকমে দুঃখ কষ্টে চলছিল আমাদের সংসার। আমাদের দাম্পত্য জীবনে নূরে এলাহী নামে ৮ বছরের একটি ছেলে আছে। সে বর্তমানে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়ছে। এই অবস্থায় ছেলেকে নিয়ে আমি কি করব, কোথায় যাব ? কিছুই জানি না। তবে আমার ছেলেটার একটা গতি হলে মরেও শান্তি পেতাম।
এ সময় তিনি সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগীতা চেয়ে বলেন, স্থানীয় ওমর ফারুক ভান্ডারী নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে জজ মিয়া জমি কেনার জন্য ৫৩ লাখ টাকা দিয়েছেলেন। এসবের লিখিত হিসেব এমপি সাবের ডাইরিতে আছে। ওই জমিটির একটা ব্যবস্থা হলে ছেলেটার একটা গতি হত। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে একাধিক মেয়র, ওসির কাছে গিয়েছি, কোন কাজ হয়নি। তারা বলে শুধু দেখছি, দেখব।
এছাড়াও এমপি জজ মিয়া একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর মুক্তিযোদ্ধার সনদটির জন্য স্থানীয় কমান্ডার ও প্রশাসনের কাছে বার বার গিয়েছি। এজন্য এক ব্যক্তিকে টাকাও দিয়েছিলাম ৬০ হাজার। কিন্তু এখনো সেই সনদটির কোন অগ্রগতি হয়নি। যদি সরকার এবং প্রশাসন এই বিষয়টি দেখত, তাহলে উপকার পেতাম।
এবিষয়ে গফরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: আবিদুর রহমান বলেন, সম্পত্তির লেনদেন বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব। তাছাড়া উনার মুক্তিযোদ্ধার আবেদন কি পর্যায়ে আছে, তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করব।