আনন্দময় ঝুলন্ত সেতু
পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে নাইক্ষ্যংছড়ির উপবন পর্যটন লেক
অনুমতিক্রমে মাছ ধরার ব্যবস্থা
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৩, ২১:০২ | অনলাইন সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড় ঘেরা উপবন পর্যটন লেকে পর্যটক উপস্থিতি বাড়ছে। আনন্দময় ঝুলন্ত সেতু, কারুকার্যময় বসার স্থান ও অনুমতিক্রমে মাছ ধরার ব্যবস্থার পাশাপাশি ছোট-বড় সকলের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশে পিকনিকের জন্য উপবন পর্যটন লেক-কেই বেছে নিচ্ছে ভ্রমণ প্রেমিরা। আর কাজে ডুবে থাকা নানা-পেশার মানুষও বিকেল হলেই রোদ-ছায়ার খেলা চলা পর্যটন কেন্দ্রে ভীড় জমাচ্ছেন। এতে বিকিকিনি বাড়ায় খুশি স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় বাসিন্দা পরিবেশকর্মী নেজাম উদ্দিনের মতে, আশির দশকেও পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ি এক ধরনের যোগাযোগহীন ভয় মাখা জায়গা ছিল। কিন্ত মতিউর রহমান নামে তৎকালিন এক ইউএনও'র সৃষ্টিশীলতায় গড়ে উঠে নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যটন উপবন লেক। তিনি প্রকৃতির উপহার পাহাড়ের চারপাশে জলকে উপলক্ষ্য করে স্থানটিকে উপভোগ্য করার উদ্যোগ নেন। স্থাপন করেন ঝুলন্ত সাঁকো। এরপরই স্থানীয় পরিবেশ প্রেমিরা সেখানে ঘুরতে আসা শুরু করেন। ধীরে ধীরে লেকটি সম্পর্কে প্রচারণা পায়। আশপাশের উপজেলাগুলোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও পেশাজীবি সংগঠন পিকনিকের জন্য স্থানটি বেছে নেয়া শুরু করেন। যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হতে থাকলে লেকে লোকসমাগমও বাড়তে থাকে। শীত মৌসুমে লোকজন বেশি আসে লেকে। সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার পর্যটকে ঠাঁসা থাকছে উপবন পর্যটন লেক এলাকা। রাঙ্গামাটি, বান্দরবানের মতো ঝুলন্ত সাঁকোটি আনন্দ দেয় ভ্রমণপিয়াসীদের। মাছ শিকার যাদের নেশা তারাও এখানে বড়শি ফেলে বিনোদিত হচ্ছেন।
পার্বত্য বান্দরবানের সর্বদক্ষিণ সীমান্ত উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ি। এর চারপাশে ঘিরে আছে পর্যটন জেলা কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফ। ফলে প্রশাসনিক কর্মকান্ড বাদে উপজেলাবাসীর বাকি সকল কার্যক্রম সারেন পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সাথে। কক্সবাজার সদর থেকে ৩৫ আর রামু সদর থেকে মাত্র ১৩ কিমি দূরত্বে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর। এ কারণে কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাঁও, চকরিয়া, উখিয়া, টেকনাফ, পেকুয়া ও কুতুবদিয়া এবং চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া থেকেও প্রকৃতিপ্রেমীরা সবুজ অরণ্যে ঘেরা লেকের সৌন্দর্য দেখতে ছুটে যান।
কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রামু চা-বাগান এলাকা দিয়ে পূর্ব দিকে চলে যাওয়া সড়কে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর। সড়কটি প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকা রামু উপজেলার দখলে। বাঁকখালী নদী পার হয়ে জারুলিয়াছড়ি বেইলি সেতু এলাকা হতেই নাইক্ষ্যংছড়ি সীমানা শুরু। আঁকাবাকা দেড় কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলে সামনে পড়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তা পেছনে ফেলে দুশ' গজ গেলে ডানপাশের উপসড়ক দিয়েই যেতে হয় উপবন লেকে। মিনিট পাঁচেক গেলেই কাঙ্ক্ষিত লেকটি পাওয়া যায়। কক্সবাজার সদর, রামু বা দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে প্রাইভেট যান বাহন নিয়ে লেকে ঘুরে আসা যাবে।
আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে উপরে উঠতেই নজরে আসবে পাহাড়ের চুড়ায় ছোট বেশ কয়েকটি ঘর। সড়ক থেকে পর্যটন স্পটে হাতের বাম দিকে তাকালে নজরে আসবে বিশাল জলপ্রপাত। এর একপাশে নজরে আসবে স্থানীয় উপজাতীদের ঘর।
চাইলে রামু ও কক্সবাজার সদর থেকে লোকাল মিনিবাস বা সিএনজি টেক্সী করেও লেকে আসা যায়। ৩০ টাকা প্রবেশ ফি-তে সারাদিন উপবন লেকে অবস্থান করা যায়।
উপবন লেকে গিয়ে দেখা যায়, পাশবর্তী বিভিন্ন উপজেলা থেকে পিকনিকের গাড়ি এসেছে অনেক। সপ্তাহিক ছুটি থাকায় সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারি ও বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষ পিকনিক স্পট হিসেবে পরিবার পরিজন নিয়ে উপবন লেকে এসেছেন। পর্যটকদের কেউ দোলনায় দোল খাচ্ছিল, কেউবা লেকের পারে বসে গল্পে মশগুল, আবার কেউবা লেকে পায়ের প্যাডলে চলা নৌকায় ভ্রমন করছেন। বাচ্চাদের আনন্দটাই সবচেয়ে উপভোগ্য।
নাইক্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান (সাবেক) মোহাম্দ ইকবাল জানান, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় বর্তমান লেকের পশ্চিম পার্শ্বে বেশ কয়েকটি পাহাড়ি ঝর্ণা ছিল। ঝর্ণার পানি সংরক্ষণে ১৯৮৭ সালে দুই পাহাড়ের মাঝখানে কৃত্রিম হ্রদ খনন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল উপজেলা সদরে পানির সমস্যা দূরীকরণ। তৎকালিন ইউএনও মতিউর রহমান এবং উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আমিই এটি বাস্তবায়ন করেছিলাম। এরপর বাঁধ নির্মাণে সহায়তা দেন তৎকালিন জেলা প্রশাসক নাজমুল আলম সিদ্দিকী। তাকে সহযোগিতা দেন বান্দরবান রিজিউন কমান্ডার ব্রিগেড়িয়ার শাখাওয়াত হোসেন, ব্রিগেড়িয়ার শাহজাহান, নাইক্ষ্যংছড়ি এলজিইডি কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হাকিম। এভাবেই ১৯৯০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের প্রায় ২৫ একর জায়গাজুড়ে লেকের পাহাড়ে কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হয় উপবন পর্যটন স্পট। তখন থেকেই উপজেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় পর্যটন স্পটটি রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে আসছে। শুরুতে এটি ”ইউএনও’র গোধা” বা লেক নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তী ঝুলন্ত সাঁকো নির্মাণের পর ”শৈলশোভা” লেক নামে পরিচিতি পায়।
স্থানীয় উদ্যোক্তা মুহাম্মদ জলিল বলেন, দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি স্থানটি দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন। তবে উপজেলায় পর্যাপ্ত হোটেল-রস্তোরা, সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা আধুনিক ভাবে গড়ে না উঠায় পর্যটকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এসব কারণে অনেক ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে রয়েছে এলাকাটি।
আনন্দ ভ্রমণে আসা ঈদগাঁওর আবু বক্কর বলেন, বনের মাঝে গড়ে তোলা আকাশ বাড়ি, পিকনিকের জন্য ছোট্ট বেশ কটা ঘর, সবুজ অরণ্য ঘেঁষে পাহাড় চূড়ার উপর প্রাকৃতিক হ্রদের এমন দৃষ্টিনন্দন রূপ আমাদের মুগ্ধ করেছে। প্রবেশ পথ থেকে সাদা সিমেন্টের শৈল্পিক ধাঁচের রেলিং উপবনের চারপাশ ঘেরা। নিচে নামলে পাহাড়ের কিনারায় কারুকার্য করা বেঞ্চ, পুরনো রান্না ঘরের পাশে বসানো হয়েছে চোখ জুড়ানো শৈল্পিক চেয়ার-টেবিল। মাঠের মাঝখানে শিশুদের জন্য দোলনা এবং পানির ফোয়ারা। প্রকৃতির মাঝে শৈল্পিক অবকাঠামোর ছোঁয়ায় বদলে গেছে পরিবেশ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, আশির দশকের পর থেকে কিছু খন্ড খন্ড উন্নয়ন হয় পর্যটন লেকের। তবে, সম্প্রতি বিদায়ী ইউএনও সাদিয়া আফরিন কচি'র হাত ধরে বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। এরপরই উপবন পর্যটন স্পট হিসেবে পূর্ণতা পেয়েছে। কিন্তু সারাদিন পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াতে পারলেও থাকার ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় দূরের পর্যটকরা রাত যাপন করতে চাইলেও পারেন না। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে হোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠলে অর্থনৈতিক কর্মক্ষেত্র গড়ে উঠতো।
নাইক্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রোমেন শর্মা বলেন, উপবন পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য বর্ধনে করণীয় সব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আগত পর্যটকদের সেজন্য বেঞ্চ, টেবিল, শিশুদের জন্য দোলনা, পানির ফোয়ারা, ওয়াচ টাওয়ারসহ বেশ কিছু অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। টাওয়ারে উঠে পাহাড়-প্রকৃতির সৌন্দর্য্য অবলোকন করা যায়। আরো কিছু পরিকল্পনা আছে, বরাদ্দ পেলে তাতে হাত দেয়া হবে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, পর্যটন সম্ভাবনাময় শিল্প। চলমান পর্যটন স্পটের পাশাপাশি নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র আবিস্কারে প্রশাসনের সুদৃষ্টি রয়েছে। নাইক্যংছড়ি উপবন কেন্দ্রে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সচেষ্ট রয়েছে প্রশাসন।