মহেশখালীতে ৪০০ একর প্যারাবন কেটে ঘের তৈরি 

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:২৫ | অনলাইন সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউয়িনের দুই পয়েন্টে বেড়িবাঁধের বাইরের বিস্তীর্ণ প্যারাবন কেটে ঘের তৈরি করছে কয়েকটি চক্র।ইউয়িনের পানিরছড়া ও মোহরাকাটার পশ্চিমে অমাবশ্যাখালী মৌজা ও কালাগাজির পাড়ার পশ্চিমে বগাচতর ঘোনার পেছনে এই ভয়াবহ ভূমিদস্যুতা চলছে। 

বনবিভাগের চোখের সামনে প্যারাবনের হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলেছে ভূমিদস্যুরা। প্যারাবন কেটে অমাবশ্যাখালী মৌজায় প্রায় ১০০ একর ও বগাচর ঘোনার পশ্চিমে প্রায় ৩০০ একর সরকারি খাস খতিয়ানের জমি দখল করে ঘের তৈরি করা হচ্ছে। সরকারি দল আওয়ামী দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতার নাম ভাঙিয়ে এই পরিবেশ বিধ্বংসী অপকর্ম চালাচ্ছে ভূমিদস্যুরা।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোহরাকাটার সাহাব উদ্দীনের নেতৃত্বে একটি চক্র পানিরছড়া-মোহরাকাটার পশ্চিমে অমাবশ্যা মৌজার বেক্সিমকোর প্রজেক্ট সংলগ্ন বেড়িবাঁধের বাইরে প্রায় ১০০ একর প্যারাবন কেটে চিংড়িঘের করছে। চক্রটি দুই মাস আগে এই প্যারাবন নিধনযজ্ঞ শুরু করে। শুরুর দিকে দিন-দুপুরে প্রতিদিন শতাধিক শ্রমিক নিয়োগ করে কেটে ফেলে প্যারাবনের প্রায় ১০ হাজার গাছ। এরপর স্কেভেটর লাগিয়ে রাতদিন মাটি কেটে ঘেরের বাঁধ তৈরি করে। ইতিমধ্যে এক কিলোমিটারের বেশি বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে লবণ চাষও শুরু করেছে এবং একটি খালও বাঁধ দিয়ে আটকে ফেলা হয়েছে।  

অন্যদিকে কুতুবদিয়ার (বর্তমানে কক্সবাজার শহরের বাসিন্দা) এরশাদের নেতৃত্বে মতিন, নাজু ও শাহাদাতসহ একটি চক্র ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বগাচতর ঘোনার পশ্চিমে প্যারাবন কেটে ৩০০ একর সরকারি জমির দখলযজ্ঞ শুরু করে। চক্রটি শুরুর তিন দিনে প্রতিদিন দুই শতাধিক শ্রমিক লাগিয়ে প্রায় ২০হাজার গাছ কেটে ফেলে। এরপর চারটি বড় আকারের স্কেভেটর লাগিয়ে শুরু করে বাঁধ তৈরির কাজ। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ-বিএনপির লড়াই চললেও সরকারি জমি দখলতে একট্টা হয়েছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতারা। দুই দলের নেতারা একজোট হয়ে প্যারাবন কেটে ভূমি দখল করে পরিবেশের ক্ষতি করছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগাচর ঘোনার পেছনের ভূমি দখলকারীদের চক্রের নেতৃত্বদানকারী এরশাদ কুতুব। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্য কালাকাজির পাড়ার আবদুল মতিন। তিনি ছাত্রজীবনে ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন।

চক্রের আরেক সদস্য নেজাম উদ্দীন নাজুও বিএনপির ঘরানার লোক। আরেক সদস্য শাহাদাত হোসেন ওয়ার্ড বিএনপির নেতা। মামলায় নাম না উঠলেও ইউনিয়ন বিএনপির একাংশের এক শীর্ষ নেতা এই চক্রের অর্থদাতা বলে মামলার তদন্তে তথ্য পেয়েছে সংশ্লিষ্টরা। 

অন্যদিকে অমাবশ্যাখালীর মৌজার সরকারি ভূমি দখল চক্রের নেতৃত্বদানকারী শাহাব উদ্দীন রাজনীতিতে সক্রিয় না হলেও আওয়ামী ঘরানার লোক। তিনি দীর্ঘদিন এলাকায় থাকেন না। তবে সম্প্রতি একটি ব্যাংকের এজেন্ট নিয়ে এলাকায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। তার জন্য গড়ে তুলেছেন লবণ চাষী কল্যাণের একটি কথিত সংগঠন।
 
শাহাব উদ্দীনের এই ভূমি দখল চক্রের অন্যতম সদস্য মারুফ নামের বড় মহেশখালীর এক ব্যক্তি। রয়েছে আরো কয়েকজন। 

এভাবে বিএনপি-আওয়ামীলীগ একট্টা হয়ে প্যারাবন কেটে পরিবেশ ধ্বংস করছেন। সরকার পরিবর্তন হলেও দখল ধরে রাখতেই এভাবে বিএনপি-আওয়ামী লীগ একট্টা হয়েছে- এমনটি বলে বেড়াচ্ছেন ভূমিদস্যুরা। বনবিভাগের চোখের সামনেই সরকারিভাবে সৃজিত প্যারাবনের প্রায় অর্ধলাখ গাছ কেটে ফেলেছে ভূমিদস্যুরা। কিন্তু তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বিষয়টি সর্বমহলে জানাজানি হয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হলে কিছুটা নড়েচড়ে বসে বনবিভাগ। এর মধ্যে নামমাত্র অভিযান চালিয়ে কিছু বাঁধ কেটেছে। দুই-তিনটি মামলা হওয়ার কথা জানা গেলেও তা নিয়ে লুকোচুরি খেলছে। এমনকি মামলার এজাহারে নাম আসা কয়েকজনের নাম বাদ দিতেও চেষ্টা করা হচ্ছে বলে কথা উঠছে। একারণে বনবিভাগের ভূমিকাকে রহস্যজনক দাবি করছেন সাধারণ লোকজন। তারা বলছেন, সুবিধা নিয়ে বা নিতে নীরব ভূমিকা পালন করছে বনবিভাগের লোকজন। 

তবে এর মধ্যে মহেশখালী থানা পুলিশের একটি দল প্যারাবন কেটে ঘের তৈরির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রণব চৌধুরীর নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে কিছু সরঞ্জামাদি গুড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

বিশাল প্যারাবন নিধন করে ঘের তৈরি করায় মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় পরিবেশ। অন্যদিকে প্যারাবন কেটে ফেলায় জলোচ্ছ্বাসে লোকালয় ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কা করা হচ্ছে। অধিগ্রহণ করা জমি রক্ষা কবচখ্যাত প্যারাবন কেটে ফেলায় সরকারের নেয়া উন্নয়ন প্রকল্পে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই নিয়ে সচেতন লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। 

সাধারণ লোকজন বলছেন, চোখের সামনে এভাবে পরিবেশ ধ্বংস হতে দেয় যায় না। এই ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। জড়িত সব ভূমিদস্যুদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা’র জেলা সভাপতি সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘আমরা খবর নিয়ে জেনেছি, মহেশখালীতে ভূমিদস্যুরা দুর্ধর্ষভাবে প্যারাবন কেটে খাস জমি দখল করছে। এতে কয়লাবিদ্যুৎসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের চাপে ঝুঁকির মুখে থাকা মহেশখালী পরিবেশগতভাবে মারাত্মকভাবে সংকটে পড়বে। আমরা চাই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত কঠোর হয়ে প্যারাবন নিধনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, মহেশখালীতে প্যারাবন কাটার বিষয়টি তাদের নজরে আসেনি। খোঁজ-খবর নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই প্রসঙ্গে বুধবার (২৫ জানুয়ারি) সকালে চট্রগ্রাম উপকূলীয় বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে  তিনি প্যারাবন কাটার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি নজরে আসার পর দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নিয়মিত পৃথক দুইটি টিম টহলে রয়েছে এবং চক্রটির বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।

তবে স্থানীয় বনবিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জের রেঞ্জার আনিসুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল ধরেননি। তাই তার বক্তব্য জানা যায়নি।