নিজ দেশ মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আর শুরু হয়নি। তবে ২০১৯ সালে দু'দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে তখন ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।
এরপরও আশ্রিতদের ফেরত পাঠাতে প্রচেষ্টা থেমে রাখেনি বাংলাদেশ সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কক্সবাজারের টেকনাফে এসেছে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল। প্রত্যাবাসনে তালিকাভুক্ত পরিবারের বাদ পড়া সদস্য রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মিয়ানমার থেকে আসা প্রতিনিধি দল যাচাই-বাছাই শুরু করেছে।
বুধবার (১৫ মার্চ) বেলা সোয়া ১১টার দিকে টেকনাফ স্থলবন্দর এলাকার ভবনে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার শুরু হয়। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধিসহ সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে উপস্থিত আছেন।
এর আগে সকাল সোয়া ১০টার দিকে স্পিড বোটযোগে মিয়ানমারের ৫ নিরাপত্তাকর্মী ও টেকনিক্যাল টিমের ১৭ সদস্য মিলে ২২জনের প্রতিনিধি দল টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটি ঘাটে পৌঁছান। বৈঠক শুরু হলে প্রতিনিধি দলের সাথে আসা ৫ নিরাপত্তাকর্মী মিয়ানমার ফিরে গেছেন।
জানা যায়, টেকনাফ স্থল বন্দরের অভ্যন্তরে মালঞ্চ সম্মেলন কক্ষে রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাই-বাচাই কাজ শুরু হয়। এতে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ'র নেতৃত্বে ১৭ সদস্যর প্রতিনিধি দল ও বাংলাদেশের পক্ষে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) অতিরিক্ত কমিশনার মুহাম্মদ সামছুদ্দৌজার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সাক্ষাতকার চলছিল।
সূত্র জানায়, তথ্য যাচাই-বাছাই মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি টেকনাফে অবস্থানকালে প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত ৪২৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই করছে। একই সঙ্গে আলাপ করা হচ্ছে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে সম্প্রতি জন্ম নেওয়া শিশুদের তথ্যও নথিভুক্ত করার বিষয়। ইতোপূর্বে, প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ৮ লাখের ৬২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছিল। ওই তালিকা থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে এক হাজার ১৪০ জনকে বাছাই করে মিয়ানমার। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সম্মতি মিললেও বাকি ৪২৯ জনের ব্যাপারে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল।
সেই ৪২৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাইয়ের জন্যই টেকনাফে এসেছে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধি দলটি বুধবার প্রথম দিনে ২৮টি পরিবারের সাথে কথা বলেছে বলে জানা গেছে। সবার তথ্য যাচাই-বাছাই শেষ করতে অন্তত ৫-৬ দিন সময় লাগতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (ক্যাম্প-২৫) মাঝি নুরুল আমিন বলেন, লেদা-নয়াপাড়া ক্যাম্পের অবস্থানকরা ২০-২৫ পরিবারের ৫০-৬০ জন রোহিঙ্গাকে ধাপে ধাপে টেকনাফ স্থলবন্দরের ভেতরে রেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ক্রমান্বয়ে নেয়া হয় প্রতিনিধিদের সামনে। সাক্ষাতকার দিয়ে ফেরা, রোহিঙ্গাদের সাথে আমি কথা বলেছি। মিয়ানমার প্রতিনিধি দল তাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছে, তারা নিজ দেশে (মিয়ানমার) ফিরতে চান কি না? জবাবে রোহিঙ্গারা বলেছেন- রোহিঙ্গা হিসাবে মর্যাদায় পূর্ণ নাগরিক অধিকার, নিরাপত্তা, জায়গা-জমি দিলেই তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবেন।
আগে মিয়ানমার অবস্থানের কোন প্রমাণ রয়েছে কিনা, প্রতিনিধি দল এমনটি জানতে চাইলে- রোহিঙ্গারা জানায়, মিয়ানমানের সীলযুক্ত কাগজ পত্র রয়েছে তাদের।
এদিকে, বৈশ্বিক চাপে আবারো সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে উদ্যোগী হওয়ায় মিয়ানমারের পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। তবে এর আগে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের তিন মাসের মাথায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি সই হলেও গত প্রায় ছয় বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনও অগ্রগতি হয়নি।
এ ছাড়া ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বেঁধে দেয়া সময়ে এক দফা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালে আবার প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এ ঘটনার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আলোর মুখ দেখেনি।
নতুন করে আবারো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো রোহিঙ্গাদের তালিকা তথ্য যাচাই-বাছাই করতে টেকনাফ জেটিঘাট হয়ে মিয়ানমারের ২২ সদস্যর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার থেকে পাঠানো রোহিঙ্গাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করতে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলতে ৬ দিনের সফরে এসেছেন। প্রথম দিনে ৮০-৯০ জন তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গার সাথে প্রতিনিধি দল কথা বলেছেন। ক্রমান্বয়ে বাকি দিনগুলোতে অন্য রোহিঙ্গাদের সাথেও কথা বলবেন তারা।
তিনি আরো বলেন, মূলত ২০১৮ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে ৮ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হয়। এরপর মিয়ানমার ৬৮ হাজার রোহিঙ্গার ফিরতি তালিকা পাঠায়। সেখানে অনেক পরিবারের সদস্য বাদ পড়ে। বিষয়টি তাদের (মিয়ানমারকে) জানানো হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে তথ্য যাচাই-বাছাই করতে তারা (মিয়ানমার) আগ্রহ প্রকাশ করে। বাদপড়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তারা কথা বলছেন, কেন বাদ পড়েছেন এবং তাদের দলিলপত্র দেখছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সরকার রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু করার পর পালিয়ে বাংলাদেশের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে ৭ লাখের অধিক রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেয়, এর আগে ছিল আরো ৪ লাখ। এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন প্রায় সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গারা। যতই দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।