ঈদে টাঙ্গাইলে শাড়ির চেয়ে থ্রিপিসের কদর বাড়ছে

প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:২৬ | অনলাইন সংস্করণ

  রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল

পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের তৈরি শাড়ি, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবীর বাজার জমে ওঠেছে। এক সময়ের আভিজাত্য ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ এখন অনেকটা উৎসব নির্ভর হয়ে পড়েছে। সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে থ্রি-পিস, সালোয়ার-কামিজ ও পাঞ্জাবী। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য তাঁত শিল্প প্রধান এলাকাগুলোতে এখন শাড়ি তৈরির পাশাপাশি থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবীর কাপড়ও তৈরি করা হচ্ছে। 

টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতি নারীদের দুর্বলতা ফিঁকে হয়ে এখন বর্ষবরণ, ঈদ, পূজা, বসন্তবরণ ও বাঙালির নানা উৎসবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এবারের ঈদুল ফিতর উপলক্ষেও নারীরা শাড়িকে প্রথম পছন্দ হিসেবে কিনছেন। পাশাপাশি একটি শাড়ির বিপরীতে ৩-৪টি করে থ্রি-পিস কিনছেন। সুদীর্ঘ সময় ধরে বাঙালি ললনার প্রথম পছন্দ শাড়ির চাহিদা পূরণে টাঙ্গাইলের তাঁত প্রধান এলাকাগুলোতে সারা বছর মহাজন ও পাইকারদের সমাগম ছিল লক্ষণীয়। এখন তা পালা-পার্বন ও উৎসব নির্ভর হয়ে পড়েছে। এবারের ঈদেও তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। 

জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন এলাকায় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি হলেও কালিহাতী উপজেলার বল্লা, কোকডহড়া, নাগবাড়ী, পাইকরা ইউনিয়ন এবং দেলদুয়ার উপজেলার চন্ডী, পাথরাইল ও সদর উপজেলার পৌলী, চরপৌলীসহ আশপাশের এলাকা তাঁতশিল্প প্রধান হিসেবে পরিচিত। 

টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প দেশের অন্যতম ও প্রাচীণ কুটির শিল্প। এ অঞ্চলের উৎপাদিত তাঁতের শাড়ি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। তাঁত শিল্প এসব এলাকার মানুষের রুজি-রোজগারের প্রধান মাধ্যম। চড়কায় সুঁতা কাটা থেকে তানা সাজানো, শাড়ি বুনানো থেকে শাড়ি বিক্রি পর্যন্ত তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত পরিবারগুলোর ছোট সদস্যটিও সম্পৃক্ত। শাড়ির বাজারের সাথে এসব এলাকার সাধারণ মানুষের ভাগ্যের চাকাও  ঘুরে। তিন বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর এবারের ঈদের বাজারেও টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের সংকট কাটেনি।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পের স্বর্ণযুগ ছিল। ওই সময় ‘দি সেণ্ট্রাল কো-অপারেটিভ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড (সিসিএএল)’ নামে সমিতির মাধ্যমে তাঁতীদের মাঝে সুতা বণ্টন করা হত। ওই সময় পিটলুম ও হ্যান্ডলুম বা খটখটি ও চিত্তরঞ্জন তাঁতে কাপড় তৈরি হত। এক পিস ভালো মানের শাড়ি উৎপাদন করতে ৩-৪দিন এবং এক পিস লুঙ্গি তৈরিতে ১২-১৪ ঘণ্টা সময় লাগতো। বাজারে চাহিদা ও দামও ছিল আশানুরূপ। কিন্তু ১৯৭৫ সালের কালো অধ্যায়ের পর তাঁতীদের জীবনেও অমানিষা নেমে আসে। সিসিএএল নামীয় প্রতিষ্ঠান প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার ক্ষমতাসীন হলে তাঁতীরা ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়াস পায়। টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছার কদর বাড়তে থাকে। দেশ-বিদেশে টাঙ্গাইল শাড়ির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তাঁত বোর্ডের সুবিধা না পাওয়ায় ১৯৯০ সালের পর দফায় দফায় রঙ, সুতাসহ কাঁচামালের দুস্প্রাপ্যতা ও অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে তাঁতীরা আবার মুখ থুবরে পড়ে। এরপর থেকে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পে ধ্বস নামতে থাকে। তাঁত ফেক্টরীগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভাবনাময় তাঁত শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। 

বাতাঁবো সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলার তাঁত শিল্পের প্রসার ঘটাতে জেলার কালিহাতী ও সদর উপজেলায় বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের (বাতাঁবো) দুইটি বেসিক সেণ্টার রয়েছে। টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার, নাগরপুর, মির্জাপুর, বাসাইল ও সখীপুর উপজেলার জন্য সদর উপজেলার বাজিতপুরে অবস্থিত বেসিক সেণ্টার থেকে ৩০৫ জন তাঁত মালিকের মাঝে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা সরল সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। কালিহাতী, ঘাটাইল, ভূঞাপুর, গোপালপুর, মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার জন্য কালিহাতী উপজেলপার বল্লায় অবস্থিত বেসিক সেণ্টার থেকে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা ক্ষুদ্র ঋণ এবং তাঁত শিল্পের আধুনিকায়নে চলতি মূলধন হিসেবে ৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কালিহাতী বেসিক সেণ্টার থেকে দেওয়া ঋণ রাজনৈতিক বিবেচনায় অপেশাদার তাঁতীদের মাঝে বণ্টনের অভিযোগ রয়েছে। 

সূত্র মতে, বাতাঁবোর টাঙ্গাইল সদর কার্যালয়ের আওতায় ১৪ হাজার ৬৪৪টি তাঁতের মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার পিটলুম এবং ৯ হাজার ১৪৪টি চিত্তরঞ্জন ও পাওয়ারলুম। কালিহাতী বেসিক সেণ্টারের অওতায় ২১ হাজার ৬৫০টি তাঁতের মধ্যে কোন পিটলুম নেই। সবগুলোই চিত্তরঞ্জন ও পাওয়ারলুম। অথচ পাওয়ারলুমের মালিকদের তাঁতের আধুনিকায়ন ও চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ দেওয়ার এখতিয়ার বেসিক সেণ্টারের নেই।

তাঁত মালিকরা জানায়, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ের লকডাউনে তাঁতে শাড়ি তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনে অসংখ্য কারিগর বেকার হয়ে পড়েন। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে যান। এরপর ২০২০ সালের বন্যায় জেলার তাঁত শিল্প আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার পানিতে কারখানার তাঁত, তাঁতে থাকা সুতার ভিম, কাপড় ও সরঞ্জামাদি নষ্ট হওয়ায় বিনিয়োগের লোকসান হয়। 

এরপরও তাঁতশিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের রমজানের আগ মুহূর্তে তাঁত ফ্যাক্টরীগুলো খুলে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে সুতা, রঙ, রাসায়নিক দ্রব্যসহ কাঁচামালের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে সেখানেও আরেকবার ধাক্কা দেয়। প্রথমে তাঁতীরা অস্থায়ী সংকট মনে করলেও ক্রমশ তাঁত শিল্প স্থায়ী সংকটে নিপতিত হয়। বর্তমানে প্রায় ৮৫ শতাংশ হস্তচালিত তাঁত বা পিটলুম ও চিত্তরঞ্জন বন্ধ রয়েছে। হস্তচালিত তাঁত বা পিটলুম ও চিত্তরঞ্জনের জায়গা দখল করছে পাওয়ারলুম। অধিকাংশ তাঁত মালিক চিত্তরঞ্জনে বৈদ্যুতিক মটর লাগিয়ে সেমি অটো বা হ্যান্ড পাওয়ারলুম তৈরি করে কাপড় বুনছেন। পাওয়ারলুমে শাড়ি, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবীর কাপড় তৈরি করা হয়। পাওয়ারলুমে তৈরি শাড়ির অধিকাংশই সিল্কের, কিছু শাড়ি হাফ সিল্ক ও শুধুমাত্র সুতায় তৈরি করা হয়। ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি সাধারণত পিটলুম ও চিত্তরঞ্জনে তৈরি হয়। পিটলুম বা খটখটি নামে পরিচিত তাঁত আড়াই থেকে তিন ফুট মাটি খুঁড়ে গর্ত করে তার উপর বসানো হয় এবং চিত্তরঞ্জন তাঁত মাটি না খুঁড়ে মাটির উপর বসানো হয়। এই দুই প্রকার তাঁতে একজন তাঁতশিল্পী বা কারিগর হাতে কাপড় তৈরি করেন বলে একেই হস্তচালিত তাঁত বলা হয়ে থাকে।

টাঙ্গাইল সদরের তাঁতী আব্দুর রহিম, আজগর আলী, রওশন আলী, নাজমুল আলম; কালিহাতীর দুলাল হোসেন, নিয়ামত আলী, আবু আলী, মোবারক হোসেন, হায়দার আলী; দেলদুয়ারের পবন দাস, সচীন রাজবংশী, হীরালাল বসাক সহ অনেকেই জানান, আজকাল বাঙালি নারীদের ৮৫ শতাংশ সালোয়ার-কামিজ বা ম্যাক্সি কাপড় পড়ে থাকেন। ১৫ শতাংশ নারী শাড়ি পড়লেও তা ৬০/১, ৬১/১, ৬২/১, ৭০/১ ইত্যাদি কাউণ্টের সুতায় তৈরি। এসব কাউণ্টের সুতায় উৎপাদিত শাড়ির দাম অনেক কম। 

তারা জানান, টাঙ্গাইলের হস্তচালিত তাঁত বিলুপ্তির পথে। অধিকাংশ কারিগর খটখটি ও চিত্তরঞ্জন ছেড়ে সেমিঅটো বা হ্যান্ড পাওয়ারলুম ও অটো বা পাওয়ারলুমে চলে গেছে। খটখটি (পিটলুম) ও চিত্তরঞ্জন তাঁতে শাড়ি বুনতে সময় বেশি লাগে। শাড়ি বুনে যা উপার্জন হয় এতে সংসার চলে না। কিন্তু পাওয়ারলুম বা সেমি অটো পাওয়ারলুমে অল্প সময়ে বেশি শাড়ি বুনানো যায়। শুধু তাই নয়, একজন দক্ষ কারিগর একসঙ্গে পাশাপাশি চারটি পাওয়ারলুমে কাজ করতে পারেন। ফলে কারিগররা পাওয়ারলুম ও সেমি অটো বা হ্যান্ড পাওয়ারলুমের দিকে ঝুঁকছে। এছাড়া অন্যান্য পেশার শ্রমিকদের উন্নয়নে নানা ধরনের সংগঠন থাকে। তাদের এ পেশায় কোন সংগঠনও নেই। যারা নিরুপায় তারাই এখনও এ পেশায় রয়েছেন। 

টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী খ্যাত পাথরাইলের শাড়ী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং এর স্বত্ত্বাধিকারী রঘুনাথ বসাক জানান, ঈদুল ফিতরের বাজারে এবছর শাড়ি বিক্রি কম। সুতার দাম একশ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। মধ্যম দামের শাড়ির বিক্রি মূল্য বাড়লেও অন্যান্য শাড়ি আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। তবুও দামি ও কমদামি শাড়ির ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। মধ্যম দামের শাড়ি কিছু কিছু বিক্রি হচ্ছে। 

তিনি জানান, বাঙালির চিরায়ত এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে প্রতিটি ঘরে ঘরে শাড়ির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাঁত শিল্প হচ্ছে দেশের অন্যতম কুটির শিল্প। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও আধুনিকায়ন প্রয়োজন।

কালিহাতী বেসিক সেণ্টারের লিয়াজোঁ অফিসার মো. কামরুজ্জামান জানান, তার কার্য এলাকার ১৭টি প্রাথমিক তাঁতী সমিতির অধীনে তিনি ঋণ বিতরণ করেছেন। ঋণের আদায়ের হারও সন্তোষজনক। বাজার ব্যবস্থাপনা ভালো হলে তাঁতীদের সুদিন ফিরে আসবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

সদর উপজেলার বাজিতপুর বেসিক সেণ্টারের লিয়াজোঁ অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, তার কার্য এলাকায় সাড়ে পাঁচ হাজারের উপরে পিটলুম রয়েছে। এখানেই মূলত ঐতিহ্যবাহী ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ উৎপাদন হয়ে থাকে। ৩২টি প্রাথমিক তাঁতী সমিতির ৩০৫ জন তাঁত মালিকের মধ্যে তাঁত শিল্পের আধুনিকায়ন ও চলতি মূলধন হিসেবে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করেছেন। ঋণের বিপরীতে আদায়ের হার ৬০ শতাংশ। একজন তাঁত মালিক ঋণ নিয়ে সুষ্ঠু ব্যবহার করলে তাঁত শিল্পের পাশাপাশি তাঁতীদেরও উন্নয়ন হবে বলে তিনি মনে করেন।