ঈদকে সামনে রেখে কর্মব্যস্ত সময় পার করছে পাবনা ঈশ্বরদীর বেনারসি পল্লীর তাঁতি ও ব্যবসায়ীরা। শত বছরের ঐতিহ্য হস্তশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ এ বেনারসী পল্লীর শাড়ি সুনাম রয়েছে দেশ ও বিদেশে।
দেশি প্রযুক্তি হ্যান্ডলুমের মাধ্যমে দক্ষ শিল্পীর নিপুন হাতে তৈরি হয়ে থাকে এই পল্লীর প্রতিটি শাড়ি। এখনো হাতে তৈরি বেনারসি শাড়ির চাহিদা রয়েছে সারা দেশে। তাইতো ঈদ, বিয়ে বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে বেনারসি শাড়ির বিকল্প নেই অনেক নারীদের কাছে। তবে ভারত থেকে অবৈধ পথে মেশিনের তৈরি বেনারসি শাড়ি দেশের বাজারে প্রবেশ করার ফলে প্রকৃত বেনারসি শাড়ির দাম পাচ্ছেনা ব্যবসায়ী ও তাঁতিরা।
ঈশ্বরদী উপজেলা ফতেমোহাম্মদপুর ও লোকসেড এলাকা সারাদেশে পরিচিত বেনারসি পল্লী হিসাবে। এ অঞ্চলের তাঁতি ও ব্যবসায়ীরা যুগযুগ ধরে দেশি প্রযুক্তি হ্যান্ডলুম ব্যবহার করে তৈরি করছে বেনারসি শাড়ি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাহারি রংয়ের নানা সাজের বেনারসি শাড়ি তৈরি করছে এখানকার দক্ষ তাঁতিরা।
করোনা পরবর্তী সময়ে ঈদকে সামনে রেখে চরম ব্যস্ততম সময় পার করছেন তারা। তবে সময়ের সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধি হয়নি তাদের। শাড়ির নকশার ওপরে নির্ভর করে কোনটা ২ দিন আবার কোনটা ৭ দিন ধরে কাজ করতে হয় তাদের। একটি শাড়ি তৈরি করে একজন শ্রমিক এক হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা আয় করে থাকেন। তবে যে পরিমাণ শ্রম ও সময় দিতে হয় একটি শাড়ি তৈরিতে সেই পরিমাণ পারিশ্রমকি তারা পায়না।
এদিকে, সমিতি থেকে লোন নিয়ে হাতে তৈরি বেনারসি শাড়ি তৈরি করে মালিক পক্ষ কোনো রকমে টিকে আছেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে কমদামের মানহীন বেনারসি শাড়ি দেশের বাজারে প্রবেশ করায় প্রকৃত বেনারসি শাড়ির সঠিক মূল্য পাচ্ছেনা।
সূতা রং আর জড়ির দাম বৃদ্ধির কারণে পণ্য উৎপাদন করতে বেশ হিমশীম খেতে হচ্ছে তাদের। বাজার কারসাজি আর ভারতের কম মূল্যের মানহীন বেনারসি শাড়ি বাজারে বিক্রি হওয়াতে অনেকেই এই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। তবু ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো শতাধিক কারিগর আর অর্ধশত ছোট বড় মালিক পক্ষ বেনারসী শাড়ি তৈরির কাজ করছেন।
কর্মরত তাঁতিরা অভিযোগ করে বলেন, সময়ের সঙ্গে দ্রব্যমূল্যে দাম বৃদ্ধি হলেও তাঁতিদের মজুরি বৃদ্ধি হয়নি। অনেক তাঁতি এই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। আগে পুরো এলাকাতে বেনারসি শাড়ির তাঁত ঘর ছিল। আর এখন হাতে গোনা কিছু রয়েছে। ভালো ভালো কারিগর চলে গেছে বাহিরে।
ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীর তাঁত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ওকিল বলেন, আমরা শেষ হয়ে গেছি, দেশি বেনারসি শাড়ির জন্য ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীর বেশ সুনাম ছিল সারাদেশে। আমাদের দেশের শাড়ি নিয়ে গিয়ে ভারতের শাড়ি বলে বাজারে বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। আবার ভারতে মেশিনের তৈরি কমদামের মানহীন শাড়িকে বেনারসি বলে ক্রেতাদের ঠকানো হচ্ছে।
এলসির মাধ্যমে যে শাড়ি আসে তার চেয়ে অবৈধ পথে অনেক বেশি শাড়ি প্রবেশ করে দেশের বাজারে। তাইতো একটি চক্র কৌশলে দেশি বেনারসি শাড়ির বাজার নষ্ট করে দিচ্ছে। আমরা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি পৃষ্টপোষকতাসহ নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। তবেই এই শিল্প বেঁচে থাকবে, তাঁতিরা বেঁচে থাকবে। নতুবা হারিয়ে যাবে দেশি হাতে তৈরি বেনারসি শাড়ি ও তাঁত শিল্প।
বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খন্দকার ওবাইদুর রহমান জিলানী বলেন, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ঈশ্বরদী বেনারসী পল্লীর ৩২ জন তাঁতিকে ৪০ লাখ ২০ হাজার টাকা আর্থিক ঋণ প্রদান করেছেন। বর্তমান বাজারে সুতা ও রংয়ের দাম বৃদ্ধির কারণে তাঁতিরা প্রত্যাশার মূল্য পাচ্ছেনা। তবে ঈদকে সামনে রেখে বেশ কর্মব্যস্ত সময় পার করেছেন তারা। তাঁতবোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসন তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করছে। সরকারের এই আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে আবারো ঘুরে দাড়িয়েছে ঈশ্বরদীর বেনারসি পল্লীর তাঁতিরা। দেশি তাঁত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার ও বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড কাজ করছে।
তাইতো ঈদকে সামনে রেখে ক্রেতারা পছন্দের বেনারসি শাড়ি কিনতে চলে আসেন ঈশ্বরদীর বেনারসি পল্লীর লোকসেট রোডে গড়ে উঠা শাড়ির দোকানগুলোতে। সারাবছর কোনো রকমে ব্যবসা হলেও ঈদকে সামনে রেখে স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশে সরবরাহ করে থাকেন ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীর হাতের তৈরি শাড়ি। এবারের ঈদে সারাদেশে কয়েক কোটি টাকার বেনারসি শাড়ি বিক্রি হবে বলে জানা গেছে।