ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুল ও সিত্রাংয়ের আঘাতের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বিচ্ছিন্ন চন্দ্রদ্বীপসহ ১৮ চরাঞ্চলের মানুষ। বিগত ঘূর্ণিঝড় গুলোতে নদী বেষ্ঠিত এসব চরাঞ্চলের প্রাণহানিসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর আভাস দিয়েছে, আগামী ১৪ মে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। এমন পূর্বাভাসে কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে এসব এলাকার মানুষের। এসব চরে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধ না থাকায় মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।
উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন নদী বেষ্টিত ইউনিয়ন চন্দ্রদ্বীপ। ছোট বড় ১১টি চর নিয়ে এ ইউনিয়ন গঠিত। যার একটির নাম চর ব্যারেট। এ চরে প্রায় ৩ হাজার মানুষ বসবাস করে। ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসে এখানকার মানুষের নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো আশ্রয়কেন্দ্র। শুধু চরব্যারেট নয়, চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চর রায়হাসেব, চর উত্তর মিয়াজান, চর কিসমত, চর নিমদী, উত্তর দিয়ারা কচুয়া, চরওয়াডেল এলাকায়ও নেই আশ্রয়কেন্দ্র। আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় চরম ঝুঁকি নিয়ে প্রাকৃিতক দূর্যোগ মোকাবেলা করেন এখানকার মানুষ। এতে ঘটে হতাহতের ঘটনা।
চর ব্যারেটের বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘চরব্যারেটে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। আর চরের চারপাশে নদী থাকায় আমরা দুরের কোনো আশ্রয় কেন্দ্রে যেতেও পারি না। আবার ট্রলারের ব্যবস্থা থাকলে ঘরবাড়ি, গরু মহিষ রেখে কেউ যেতে চায় না।’
সাবেক ইউপি সদস্য মো. নাগর আলী হাওলাদার বলেন, চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। আর চরব্যারেট চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন। মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ অতি গুরুত্বপূর্ণ।
রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির চন্দ্রদ্বীপ ইউপির টিম লিডার মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘চন্দ্রদ্বীপে আশ্রয় কেন্দ্র সংকট রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বসে প্রায় প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। রেড ক্রেসিন্ট সোসাইটির কর্মীরা মানুষের সচেতনা বৃদ্ধিতে কাজ করে থাকি।
চন্দ্রদ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক আলকাছ বলেন, ‘চন্দ্রদ্বীপে ২৫ হাজার মানুষ বসবাস করে। সাইক্লোন শেল্টার আছে মাত্র ৫টি। ঝুঁকিপূর্ণ ৬টি এলাকায় নেই কোনো আশ্রয়কেন্দ্র। আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিক বার লিখিত আবেদন করেছি। কোনো কাজ হচ্ছে না।
এদিকে, উপজেলা ধুলিয়া ইউনিয়নের নদী বেষ্টিত বিচ্ছিন এলাকা চর বাসুদেব পাশা। বাসুদেবপাশায় প্রায় ২শতাধিক মানুষ বসবাস করেন। এখানেও নেই কোনো আশ্রয়কেন্দ্র। ঘূর্ণিঝড়ের সময় অনেকে ঘর বাড়ি ফেলে রেখে ধুলিয়া স্কুল এন্ড কলেজের আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করেন। তবে অনেকে ঘর-বাড়ি, গরু-মহিষের মায়ায় ঝুঁকি নিয়ে ওই চরেই অবস্থান করে।
ঘূর্ণিঝড়ে আরেক ঝুঁকিপূর্ণ চর ফেডারেশন। কালাইয়া ইউনিয়নের অংশ এ চর। এখানে অর্ধশত মানুষ বসবাস করে। এখানেও নেই আশ্রয়কেন্দ্র। ২০০৭ সালের সিডরে ৪৫জন নারী, পুরুষ ও মহিলার প্রাণহানী ঘটে। তারপর থেকে অনেকেই ফেডারেশন ত্যাগ করেছেন। এখনো কয়েকটি পরিবার বসবাস করে।
এছাড়াও নদী তীরবর্তী কালাইয়া ইউনিয়নের চরকালাইয়া, বগী, শৌলা, নাজিরপুর ইউনিয়নের নিমদী, ধানদী, তাঁতেররকাঠি, তালতলী, কেশবপুর ইউনিয়নের ভরিপাশা, বাজেমহল, চর মমিনপুর, ধুলিয়া ইউনিয়নের মঠবাড়িয়া, ধুলিয়া এলাকার মানুষও ঘূর্ণিঝড় ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। মানুষ এসব আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিলেও বিপাকে পড়ে গবাদী পশু গরু, ছাগল ভেড়া ও মহিষ।
তথ্য মতে, সিডরসহ বিগত ঘূর্ণিঝড়ে উপজেলার চরফেডারেশনে ৪৫জন, চন্দ্রদ্বীপে ৭জন, কেশবপুর, কালিশুরী ও কনকদিয়ায় ৫জন নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছেন। এসব চরাঞ্চলে বেড়িবাঁধ না থাকায় বেশি ক্ষতির মূখে পড়ে ফসল। বিশেষ করে বোরো ধানসহ রবিশস্য। বিভিন্ন সময় নদী ভাঙন থেকে রক্ষায় ও জলোচ্ছ্বস ঠেকাতে বেড়িবাঁধের দাবি করে আসছে এলাকাবাসী।
ধুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ধুলিয়ার চর বাসুদেব পাশায় কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় ওখানে মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে থাকেন। আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ঝড়ের পূর্বাভাস পেলে ট্রলারে করে বাসুদেব পাশার লোকজনকে ধুলিয়ার আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে আসি।
বাউফল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আল আমিন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় মানুষের জান মালের নিরাপত্তার জন্য ১৫৭টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়। তবে বিচ্ছিন্ন জনপদ চন্দ্রদ্বীপে তুলনামূলক কম সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে। ওখানে বেশ কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রাণলয়ে প্রস্তাব পাঠাবো।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. হুমায়ুন কবির জানান, জেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জেলায় ৭০৩টি সাইক্লোন শেল্টার ২৬টি মুজিব কেল্লা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি বহুতল ভবনগুলোকেও ব্যবহার করা হবে। এছাড়া গৃহপালিত প্রাণীদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুর্যোগ চলাকালে শুকনো খাবারের জন্য আট লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকা ও ৪০০ মেট্রিক টন চাল, ১৪৬ বান্ডিল ঢেউটিন ও গৃহনির্মাণ বাবদ চার লাখ ৩৮ হাজার টাকা মজুত রাখার তথ্য জানানো হয়।
এছাড়া প্রয়োজনে সরকারকে নগদ অর্থ এবং শুকনো খাবারের চাহিদাও দেয়া হয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ৭৬টি মেডিকেল টিম, সিপিপি ৮৭০০ জন, প্রতি উপজেলায় রেড ক্রিসেন্টের ২৫ জন করে স্বেচ্ছাসেবক, ফায়ার সার্ভিসের কমিউনিটি ভলান্টিয়ারসহ স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে।