নকলায় ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কামার সম্প্রদায়

প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৩, ১৪:৩৯ | অনলাইন সংস্করণ

  নকলা (শেরপুর) প্রতিনিধি

মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ হলো ঈদ-উল-আযহা। সবচেয়ে বড় আয়োজনে ও ভাবগম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ঈদ-উল-আযহা পালন করা হয়। এবছরের ঈদ-উল-আযহা আর মাত্র কয়েকদিন বাকি।

আগত ঈদ-উল-আযহার আনন্দ যেন সবার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে। আর এই ঈদকে সামনে রেখে কোরবানীর পশু জবাইয়ের অন্যতম উপকরণ চাকু, দা, ছুরি, বটি, চাপাতিসহ লোহার বিভিন্ন সামগ্রীর চাহিদা বেড়েছে। এসব তৈরীতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন পেশাদার কামার সম্প্রদায়। তারা যেন দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না।

জানা গেছে, ধান কাটার মৌসুমে কাঁচি এবং কোরবানী ঈদে চাকু, ছুরি, চাপাতি, বটির বেশি দরকার পড়ে। তখন এসব তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সব এলাকার কামার সম্প্রদায়। কামার পাড়ার দিন-রাত টুং টাং শব্দে মুখরিত থাকে আশপাশের এলাকা। এবছরও এর ব্যতিক্রম হচ্ছেনা।

মেশিনের তৈরি লোহার যন্ত্রপাতি দেখতে সুন্দর ও অধিক ধারালো হয়, এমনকি দাম ও সময় অপেক্ষাকৃত কম লাগে। তাই কামারদের তৈরি জিনিসের চেয়ে মেশিনের তৈরি চাকু, দা, ছুরি, বটি, চাপাতিসহ বিভিন্ন সামগ্রীর কদর ক্রমেই বাড়ছে। বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতেই মূলত কিছু কামার এখনো এ পেশায় জড়িয়ে আছেন বলে অনেক কামাররা জানান। তারা বলেন, পরিশ্রমের তুলনায় এই পেশায় সাধারনত আয় ও সম্মান উভয়ই কম। তাই আমাদের অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।

কামাররা জানান, এক সময় তাদের বেশ কদর ছিল, বর্তমানে তা আর নেই। এখন হাতে তৈরী জিনিসের কদর কমে গেছে। তাই সারাবছর তেমন কোন কাজ থাকেনা। তবে ধান কাটার মৌসুম ও কোরবানি উপলক্ষে তাদের কাজের চাহিদা বেড়ে যায়। এসময় তাদের দৈনিক এক হাজার টাকা থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় হলেও, ব্যয় বাদে তাদের হাতে থাকে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।

নকলা শহরের ছাত্রী ছাউনির পিছনের লোহার তৈজসপত্র তৈরির কারিগর (কামার) মস্তুফা মিয়া বলেন, আমি অন্য কোন কাজ তেমন পারিনা, তাই বাধ্য হয়েই বাপ-দাদার এই ঐতিহ্যবাহী কর্মকে এখনো ধরে রেখেছি। এ আয় দিয়েই সংসার ও ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার খরচ বহন করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, আগে নকলা শহরের প্রাণকেন্দ্রের কাচারী মসজিদ মোড় হতে পূর্বদিকে যাওয়ার রাস্তায় বেশ কিছু কামারের দোকান ছিল। আর তাদের অবস্থানগত পরিচিতির জন্যই নকলা শহরের জনবহুল ও গুরুত্বপূূর্ণ ওই এলাকার নামকরণ করা হয়েছিল কামার পট্টি (নতুন নাম গ্রীনরোড)। 

অন্য এক কামার নজরুল ইসলাম বলেন, কয়েক বছর পূর্বেও নকলা বাজারে অর্ধশত কামারের দোকান ছিল। কিন্তু মেশিনের তৈরি লোহার যন্ত্রপাতির দাপটে তা কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে নকলা বাজারে ৮-১০ টি কামারের দোকান রয়েছে।

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার নারায়নখোলা, চন্দ্রকোণা, বারমাইশা, উরফা, গনপদ্দী, কৃষ্ণপুর, ছাল্লাতুলা, শিববাড়ি, পাঠাকাটা, খারজান, বিহারিরপাড়, চিথলিয়া, বাউসা বাজারসহ বিভিন্ন হাটবাজারে কিছু কিছু কামারের দোকান আছে। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পেশাদার এসব কামাররা লোহা কিনে সেগুলোকে আগুনে পুড়ে দা, বটি, চাকু, চাপাতিসহ লোহার বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি করছেন।  তৈরিকৃত জিনিসপত্র দিয়ে নিজ নিজ দোকান সাজিয়ে রেখেছেন। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক ক্রেতা তাদের চাহিদা মোতাবেক কামারের দোকান থেকে জিনিস কিনছেন।

কামাররা এসব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মৌসুমি চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারীও বিক্রি করেন বলে জানা গেছে। অনেক ক্রেতা জানান, গত বছরের তুলনায় এবার লোহার দাম অনেক বেশি হওয়ায় লোহার তৈরি জিনিসের দামও বেড়েছে। দা ২৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা, ছুরি ছোট ১৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা, বটি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, চাপাতি ১,০০০ টাকা থেকে একহাজার ৫০০ টাকা করে বেচা-কেনা হচ্ছে। কামররা বলছেন, লোহার দাম ও শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় যন্ত্রপাতির দাম একটু বেড়েছে।

অনেকে জানান, মেশিনে তৈরি আধুনিক যন্ত্রের প্রভাবে কামার শিল্পের দুর্দিন চললেও ঈদুল আযহার মৌসুমে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আলোর মুখ দেখে। তবে কামার শিল্পীরা আশংকা প্রকাশ করে বলেন, মেশিনের সাহায্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরি হওয়ার ফলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তবা এই পেশা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তখনকার প্রজন্ম কামার কে? তাদের কাজ কি? তারা কি ধরনের জিনিস বানায় বা বানাত? এবিষয়ে চিনতে-জানতে পারবে না। অন্তত বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে এই কামার শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখতে সকলকে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করছেন সুশীলজন।