টাঙ্গাইলে ১৩টির মধ্যে ৯টি মডেল মসজিদ নির্মাণ অনিশ্চিত
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৩, ১৭:১৮ | অনলাইন সংস্করণ
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
টাঙ্গাইলে জমি নিয়ে জটিলতা ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের গাফিলতির কারণে ৯উপজেলায় ৯টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জেলার কালিহাতী, দেলদুয়ার, সখীপুর, মির্জাপুর, ঘাটাইল, মধুপুর, ভূঞাপুর, নাগরপুর ও গোপালপুর উপজেলায় স্থান নির্ধারণে জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়হীনতা, জমি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের গাফিলতির কারণে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা যাচ্ছেনা। ফলে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় ওই প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থ বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ফেরত যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
জানাগেছে, দেশে ৫৬৪টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ৮হাজার ৭২২কেটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭সালের এপ্রিলে প্রকল্প হতে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে গণপূর্ত অধিদপ্তর ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পরে প্রকল্পের নতুন মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।
মেয়াদ বাড়ানোর জন্য মোট খরচ ৮দশমিক ১৭শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। ওই প্রকল্পের অংশ হিসেবে টাঙ্গাইল জেলা সদরে একটি এবং জেলার ১২টি উপজেলায় ১২টি মোট ১৩টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জেলা শহরে মডেল মসজিদ নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ ব্যতিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার টাকা এবং উপজেলাগুলোর প্রতিটির নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ ব্যতিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে মোতাবেক বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, টাঙ্গাইল গণপূর্ত অধিদপ্ত জেলায় ১৩টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মধ্যে ৭টির দরপত্র আহ্বান করে। এরমধ্যে টাঙ্গাইল জেলা শহরে একটি এবং ধনবাড়ী ও বাসাইল উপজেলায় দুইটি মডেল মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হয়। ওই তিনটি মডেল মসজিদ গত ১৭ এপ্রিল চতুর্থ ধাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে যুক্ত হয়ে ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেছেন।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় একটি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রর নির্মাণ কাজ চলছে। কাজের অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে দরপত্র আহ্বানকৃত কালিহাতী, দেলদুয়ার ও সখীপুর উপজেলায় তিনটি মডেল মসজিদ নির্মাণে ঠিকাদাররা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগদির কারণ দেখিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। পরে মডেল মসজিদ নির্মাণে গাফিলতির কারণে ওই তিনটির ঠিকাদারদের কার্যাদেশ(চুক্তিপত্র) বাতিল করা হয়েছে। এ তিনটি উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ কাজ শেষ করতে দ্রæত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে।
মির্জাপুর, ঘাটাইল ও মধুপুর উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণের জন্য জমি নিয়ে জটিলতার বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকের পর সম্প্রতি নিরসন করা হয়েছে। এ তিনটি মডেল মসজিদ নির্মাণে দ্রুত দরপত্র আহ্বান করা হবে। ভূঞাপুর, নাগরপুর ও গোপালপুর উপজেলায় তিনটি মডেল মসজিদ নির্মাণে স্থান নির্বাচন নিয়েই জটিলতা তৈরি হয়েছে। স্ব স্ব স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মসজিদের স্থান নির্বাচনে একমত হতে পারছেন না। এরমধ্যে নাগরপুর উপজেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা পর পর তিনটি স্থান বাছাই করেন। পরে সর্বসম্মতিক্রমে উপজেলা পরিষদের ভেতরে স্থান নির্বাচন করলে জনৈক বুলবুল কাজী অধিকার ক্ষুন্নের অভিযোগ এনে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করায় মডেল মসজিদ নির্মাণের ‘স্থান নির্বাচন’ স্থগিত রয়েছে।
গোপালপুর উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির বৈরাণ নদীর পশ্চিম(ডানতীর) পাড়ে নন্দনপুর এলাকায় মডেল মসজিদ নির্মাণের স্থান নির্বাচন করেন। কিন্তু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোপালপুর বাসস্ট্যান্ডের পূর্বপাশে প্রধান সড়ক ঘেষে মসজিদ নির্মাণের দাবি জানান।
এ নিয়ে উভয় নেতার মধ্যে বিরোধ দেখা দেওয়ায় এ উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণের স্থান নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি।ভূঞাপুর উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণে প্রথমে ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি নির্বাচন করে অধিগ্রহন করতে চাইলে ওই ব্যক্তি নিজের জমিতে আদালতে মামলা করে নিষেধাজ্ঞা জারি করান।
পরে সড়ক ও জনপথের পরিত্যক্ত ২৩ শতাংশ ভূমি নির্বাচন করে মডেল মসজিদ নির্মাণে অনুমোদন চাওয়া হয়। কিন্তু সওজ কর্তৃপক্ষ ১০ শতাংশ ভূমির অনুমোদন দেয়। মডেল মসজিদ নির্মাণে ওই পরিমাণ জায়গা পর্যাপ্ত না হওয়ায় তা স্থগিত করা হয়েছে।
কালিহাতী মডেল মসজিদ নির্মাণের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দাস ট্রেডার্সের মালিক পাপন কুমার ভানু জানান, প্রথম দিকে স্থানীয় এমপির অসহযোগিতায় কাজ করা যায়নি।
পরে কোভিড-১৯ এর ধাক্কার পর দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে তিনি মসজিদটি নির্মাণ করতে পারছেন না।ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. বেলাল হোসেন জানান, জমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ভূঞাপুরে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি নির্মাণ করা যায়নি। সবশেষ উপজেলা পরিষদের কাছাকাছি মডেল মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্যের পছন্দ না হওয়ায় গোপালপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। তিনি যেখানে মডেল মসজিদ নির্মাণ করতে বলেন সেখানে বৈরাণ নদী পাড় হয়ে যেতে হয়। সেতু না থাকায় নদীর পূর্বপাড়ের মানুষ ওখানে যেতে পারবে না। তিনি আক্ষেপ করে জানান, মূলত তারা জনপ্রতিনিধিরা একমত হতে না পারায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।
নাগরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুছ ছামাদ জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য(আহসানুল ইসলাম টিটু) সহ সকল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপজেলা পরিষদের ভেতরে মডেল মসজিদ নির্মাণে স্থান নির্বাচন করেন। কিন্তু বুলবুল কাজী নামে জনৈক ব্যক্তি উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করার কারণে উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ কার্যত স্থগিত রয়েছে।
টাঙ্গাইল গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুল ইসলাম জানান, জেলায় ১৩টি মডেল মসজিদের মধ্যে মাত্র তিনটির উদ্বোধন করা হয়েছে। একটির ৭৬ শতাংশ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, বাকি কাজ চলমান রয়েছে।
তিনি জানান, ৯টি উপজেলায় ৯টি মডেল মসজিদ নির্মাণ অনিশ্চিত পর্যায়ে রয়েছে। এরমধ্যে ৩টি মসজিদ নির্মাণে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির অযুহাতে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেছে। পরে ওই তিনটি মসজিদের ঠিকাদারদের কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) বাতিল করা হয়েছে। তিনটি মসজিদের জমি সংক্রান্ত জটিলতা একাধিকবার অংশীজনদের সাথে বৈঠক করে নিরসন করা হয়েছে। জমি সংক্রান্ত জটিলতার জন্য ভূঞাপুর ও গোপালপুুর উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করা যাচ্ছেনা।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জানান, ৯টি উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ না হওয়ার কারণ নির্ণয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন আনা হয়েছে। পরে মডেল মসজিদ নির্মাণের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ‘বিশেষ সভা’ করে নির্মাণ না হওয়ার কারণ নির্ধারণ ও পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হয়েছে। এ বিষয়ে জমি অধিগ্রহণ সহ আইনি সকল ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে স্ব স্ব স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সহযোগিতা করলে প্রতিটি উপজেলায়ই মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দ্রুত নির্মাণ করা হবে।
টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির জানান, তার নির্বাচনী এলাকা গোপালপুর-ভূঞাপুরে মডেল মসজিদ নির্মাণে জমি নিয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। সে অবস্থা এখন কেটে গেছে। ভূঞাপুর উপজেলার পাশে মডেল মসজিদ নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল এসে গোপালপুর উপজেলা সদরের তিনটি স্থান পরিদর্শন করে গেছেন। তারা যে স্থান নির্বাচন করবেন সেখানেই মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হবে।
মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো: নজিবুর রহমান জানান, দেশে মোট ৫৬৪টি মডেল মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২০০টি মসজিদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। অন্যগুলোও নির্মাণাধীণ। স্থান নির্বাচনে শুধুমাত্র টাঙ্গাইল ও যশোর জেলা পিছিয়ে থাকায় মসজিদের নির্মাণ কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে টাঙ্গাইলের কয়েকটি উপজেলায় জমি অধিগ্রহন করা হচ্ছে। প্রতিটি উপজেলায়ই মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ হবে এবং এর সুফল জনসাধারণ ভোগ করবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ ওজু ও নামাজের আলাদা জায়গা রয়েছে। এছাড়া হজযাত্রীদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গবেষণা কেন্দ্র ও ইসলামিক লাইব্রেরী, অটিজম কর্নার, দাফন পূর্ব আনুষ্ঠানিকতা, গাড়ি পার্কিং সুবিধা, হিফজখানা, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও কোরআন শিক্ষা ব্যবস্থা, ইসলামিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও ইসলামের দাওয়াতের জন্যে সম্মেলন কেন্দ্র, ইসলামি বই বিক্রয় কেন্দ্র, মসজিদসহ দেশি-বিদেশি অতিথিদের জন্য থাকার সুবিধা থাকছে।