ঈদে অধিকাংশ গরু অবিক্রিত

৫২ মণের ‘মানিক’ বিক্রি না হওয়ায় কলেজছাত্রী হামিদার স্বপ্নভঙ্গ

প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৩, ১৮:৪৯ | অনলাইন সংস্করণ

  টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

একটি বড় খামার হবে, খামার পরিচালনা করে দুই বোনের লেখাপড়া চালাবেন, বাড়ির আঙিনায় হাঁস-মুরগী ঘুরে ফিরে বেড়াবে- এমনই স্বপ্ন দেখেছেন কলেজছাত্রী হামিদা আক্তার। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তার। এবারের কোরবানির হাটে বিক্রি হয়নি ৫২ মণ ওজনের ‘মানিক’। হামিদা আক্তারের বড় খামারী হওয়ার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। ছয় বছর আগে অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের তিনটি গরু দিয়ে তিনি স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন। গত বছর একই জাতের ‘রতন’কে অল্প দামে বিক্রি করে শেষ ভরসা ছিল ৫২ মণের মানিক। তার স্বপ্ন হাতের নাগালে এসে আবারও হাত ফসকে বেড়িয়ে গেল। মানিককে নিয়ে এখন তিনি বিপাকে পড়েছেন। স্বপ্ন ছোঁয়ার সুযোগ এসেও হয়েছে হাতছাড়া। 

হামিদা আক্তার টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের ভেঙ্গুলিয়া গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক আব্দুল হামিদ ও রিনা বেগমের মেয়ে। তিনি টাঙ্গাইলের সরকারি সা’দত কলেজ থেকে ইতিহাসে অর্নাস পাস করেছেন। ২০১১ সাল থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি গরুর বড় খামারী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। 

আব্দুল হামিদ ও রিনা বেগমের তিন মেয়ের মধ্যে হামিদা আক্তার বড়। ভিটে-বাড়িসহ বাবার জমি মাত্র ৫০ শতাংশ। বাবার পক্ষে তিন বোনের পড়ালেখা এবং সংসারের খরচ বহন করা অসম্ভব কষ্টসাধ্য। তাই ২০১১ সাল থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি দর্জির কাজ শুরু করেন। দর্জির কাজ করার সময়ই স্বপ্ন দেখেন গরুর বড় খামারী হওয়ার।

স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি প্রথমে রাজহাঁস ও কবুতর লালন-পালন এবং বিকাশ এজেণ্ট ও ফ্ল্যাক্সি লোডের ব্যবসা করতে থাকেন। মনের সুপ্ত বাসনার বহি:প্রকাশ ঘটাতে ২-১টি করে অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের গরু পালন শুরু করেন। এসবের আয় থেকে চলেছে তিন বোনের লেখাপড়াসহ সংসারের সকলের ভরণ-পোষণ। এরই মধ্যে দুই বোনকে এইচএসসি পাস করিয়ে একজনকে বিয়ে দিয়েছেন। অন্যজন নার্সিং-এ পড়ালেখা করছেন। এবারের ঈদুল আজহা হামিদা আক্তারের গরুর বড় খামারী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়ায়। টাঙ্গাইল জেলার সবচেয়ে বড় ৫২ মণ ওজনের অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড় ‘মানিক’কে বিক্রি করার মাধ্যমে স্বপ্ন পুরণের আশা করেন তিনি। কিন্তু বিধি বাম। বিক্রি হয়নি মানিক। 

বিশাল আকৃতির গরু ‘মানিক’কে এবারের কোরবানির ঈদে বিক্রি করতে না পেরে চরম হতাশ কলেজছাত্রী হামিদা আক্তার। দেশীয় খাবার খাইয়ে পরম যত্নে লালন-পালন করে মানিককে বড় করে তুললেও ক্রেতার অভাবে বিক্রি করতে পারেননি। 
 
হামিদা অভিযোগ করেছেন, টাঙ্গাইলের সবচেয়ে বড় গরু বিক্রির জন্য জেলা বা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য পাননি। 
তিনি জানান, তার কোন ভাই নেই। লোকবল সংকটসহ নানা অসুবিধার কারণে এবার মানিককে ঢাকার হাটে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বাড়ি থেকে গরুটি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। দুই-একজন ক্রেতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশন দেখে যোগাযোগ করলেও তারা পোল্ট্রি মুরগীর দামে গরুটির মাংস কিনতে চান। অনেকেই নামমাত্র কেজি দরে গরুটির মাংস কিনতে চেয়েছেন। সঠিক দাম তো দূরের কথা কেউ কেনার মতো দামও দেয়নি।  

হামিদা আক্তার জানান, তার আদরের গরু মানিকের ওজন ৫২ মণ। ঈদের আগে মুন্সিগঞ্জের একজন ফোনে গরুটির দরদাম করেন। সর্বশেষ ১৩ লাখ টাকায় গরুটি দাম করা হয়। তবে ঈদের আগে তিন লাখ টাকা দিয়ে গরু নিতে চান। ঈদের পরে বাকি ১০ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন ওই ক্রেতা। বাকিতে হামিদা গরুটি বিক্রি করতে রাজি হননি। এছাড়া কয়েকজন দাম-দর করেছিলেন। সর্বশেষ একজন ক্রেতা সাড়ে ৮ লাখ টাকা দাম করেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি আর আসেননি।

হামিদা জানান, একজন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কথা বলে একজন ক্রেতা যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি ৩০০ টাকা কেজি দরে দাম করেছিলেন। কিন্তু এতো কম দামে তিনি বিক্রি করতে চান নি। এছাড়া ঈদের পরেও কয়েকজন ফোন করেছিলেন। স্কেল ওজনের মাধ্যমে কেউ ১৫০ টাকা কেউ ২০০ টাকা কেজি দরে দাম করছেন। 

তিনি জানান, গরু হাটে ওঠাতে ৫-৬ জন মানুষের প্রয়োজন হয়। কিন্তু লোকজনের অভাবে হাটে নেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে এ বছরও মানিককে লালন-পালন করবেন বলে জানান তিনি।  

দেলদুয়ার উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. বাহাউদ্দীন সারোয়ার রিজভী জানান, হামিদা আক্তারের ফ্রিজিয়ান জাতের গরুটি বিক্রির জন্য সবার্ত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। গরুটি কিনতে অনেকেই হামিদাকে ফোন করেছিলেন। এছাড়া দামও করেছিল কিন্তু তিনি গরুটি বিক্রি করেননি। 

তিনি জানান, এতো বড় গরু তার বাড়ি থেকে বের করাও কঠিন হবে। কয়েক সপ্তাহ পর হামিদার গরুটি যদি কেজি দরে বিক্রি করতে চান- তাহলে যেকোনো কোম্পানির কাছে বিক্রি করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রানা মিয়া জানান, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে জেলায় তিন হাজারের বেশি খামারে এ বছর এক লাখ ৯১ হাজার ৯৪৩টি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়। এ বছর কোরবানির পশু হাটগুলোতে কম বিক্রি হয়েছে। জেলায় এবছর এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি পশু কোরবানি করা হয়েছে।