বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ী ঢল

কক্সবাজারে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, পানিবন্দি তিন লাখ মানুষ

প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ১৭:৫৪ | অনলাইন সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

টানা বৃষ্টি, জোয়ারের পানি ও পাহাড়ী ঢলে কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, ঈদগাঁও, রামু উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার প্রায় পাঁচলাখ মানুষ পানিবন্ধি হয়ে পড়ছে। 

ভেঙ্গে পড়ছে কাচা ঘরবাড়ি, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। তলিয়ে গেছে প্রায় ৩০ হাজার একর ফসলি জমি ও চিংড়ি ঘের। অনেক সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। 

কোনো কোনো ইউনিয়নে সড়ক ও বেড়িবাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রশাসনের জরুরি সহযোগিতা কামনা করেছেন ভূক্তভোগী মানুষগুলো। 

প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্ধি মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি শুকনো খাবার সরবরাহ করার কথা জানানো হয়।

তথ্য মতে, সোমবার (৭ আগস্ট) অতিবর্ষণে পাহাড় ধসে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আনোয়ার ইসলামের স্ত্রী জান্নাত আরা (২৮) ও তার মেয়ে মাহিম আক্তার (২) এবং চকরিয়ায় বরইতলী ইউনিয়নের বড়ঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে ঘরের দেয়াল ভেঙে মাটি চাপায় আনোয়ার হোসেনের ৫ বছর বয়সী ছেলে সাবির ও ১ বছর বয়সী মেয়ে তাবাবসুম নিহত হয়েছে। 

রামুর রাজারকুল ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের মৌলভীপাড়ায় বন্যার পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে সৌদী প্রবাসী মৌলভী ওবাইদুল হকের ২ বছর বয়সী শিশু সামিয়া। একই দিন চকরিয়া মাতামুহুরি নদীতে পাহাড়ী ঢলে ভেসে আসা কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে শাহ আলম নামে আরো এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে।

গতকাল (মঙ্গলবার) সকালে পেকুয়া সদর ইউনিয়নের মাতবরপাড়া এলাকার নাছির উদ্দিন (৪৫) নামের এক ব্যক্তি সাপের কামড়ে নিহত হয়েছে। একই দিন মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়ার মাইজপাড়া এলাকায় বাড়ির দেয়াল ধসে একই পরিবারের ৪ জন আহত হয়েছে। আহতরা হলেন মোঃ আলী(৬০),আসমাউল হোসনা (১০), সিফাত (৮) ও মনিরা খানম (১২)।

কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানান তিনি।

এদিকে বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে জেলা প্রশাসনের দেয়া এ তথ্য মতে, জেলার ৯টি উপজেলার ৬০ টি ইউনিয়নে মোট ২ লাখ ৯৯ হাজার ১৫৩ জন দূর্গতের কবলে পড়ে। যেখানে ক্ষতি ধরা হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ ৫ হাজার টাকা। মোট ৫৭৬টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ২০৮ খোলা রাখা হয়েছে। যেখানে আশ্রয় নিয়েছে ৩৩ হাজার ৭৩৭জন। চলমান বর্ষায় ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ৯টি উপজেলায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও চকরিয়া এবং পেকুয়ায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আংশিক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। 

এছাড়া চকরিয়া-বদরখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে ৬কিলোমিটার, ইয়াংচা-মানিকপুর-শান্তিবাজার সড়কে ১৯ কিলোমিটার, লক্ষ্যারচর-বেথুয়াবাজার-বাগগুজারা সড়কে ১১ কিলোমিটার, একতাবাজার-বনৌজা শেখ হাসিনা সড়কে ০.৫ কিলোমিটার, বড়ইতলি-মগনামাঘাট ৭ কিলোমিটার, মহেশখালীতে ৩টি ছোট কালভার্ট ,উখিয়ায় ৩ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা এবং টেকনাফে-কক্সবাজার মহাসড়কে ২.৫ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় দূর্গত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ৫৮ মে.টন চাল ও ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে, রবিবার ভোর থেকে শুরু হওয়া টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে চকরিয়া পৌরসভা, উপজেলার হারবাং, বরইতলী, কাকরা, মানিকচর, লক্ষ্যাচর, ভেওলা, কৈয়ারবিল, বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর মানিকপুর, পূর্ব বড় ভেওলা, ফাঁসিয়াখালী, কোনাখালী, খুটাখালী, চিরিংগা, ঢেমুশিয়া, ডুলাহাজারা, পশ্চিম বড় ভেওলা, বদরখালী, লক্ষ্যারচর, সাহারবিল, ভেওলা মানিকচর প্রায় ৮-১০ ফুট পানির নীচে রয়েছে। 

সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি পানিবন্ধি মানুষগুলো রান্নাবান্নার কাজ করতে না পেরে তিব্র খাবার সংকট ও সুপেয় পানির অভাববোধ করছেন। চকরিয়া থানা, চকরিয়া কলেজসহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখনো পানির নীচে রয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে জানান তারা। 

এছাড়া রয়েছে বিষাক্ত সাপ বা অন্য প্রাণীর ভয়ও। ,চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেপি দেওয়ান বলেন, নিম্নাঞ্চলের মানুষের জন্য সোমবার থেকে উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। তাদের জন্য শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

মহেশখালীর মাতারবাড়ি ইউনিয়নের জালিয়াপাড়া, ষাইটপাড়া এবং ধলঘাটা ইউনিয়ন মানুষ পানিবন্ধি হয়ে পড়েছেন। মূলত বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারের পানি এবং বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়েছে এসব এলাকা। প্রবলবর্ষণে কালারমরছড়া এলাকায় ঘরের দেয়ার ভেঙ্গে আহত হয়েছে চারজন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্ধি মানুষকে নিরাপদে আশ্রয় শিবিরে নিয়ে যাওয়ার কাজ চলছে।

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীকি মারমা জানান, মাতারবাড়িতে যারা পানিবন্দি রয়েছে তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। তাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করে জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানিয়েছেন, গত কয়েক দিন ধরে প্রবল বর্ষণ ও পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ার অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে উচ্চ জোয়ারের কারণে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। 

প্লাবিত এলাকায় ইতিমধ্যে ৫৮ মেট্টিন চাল ও ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে সহায়তা দল কাজ করছেন। প্লাবিত এলাকা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উদ্ধার তৎপরতা সহ সার্বিক সহায়তার জন্য সেনা বাহিনী ও নৌ-বাহিনী মাঠে রয়েছেন।

পেকুয়া প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান অপুর দেয়া তথ্য মতে, পেকুয়া উপজেলার পেকুয়া সদর, উজানটিয়া, টইটং, বারবাকিয়া, মগনামা, রাজাখালী এবং শীলখালী ইউনিয়নের প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্ধি। সড়ক উপসড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় নৌকাই একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে দাড়িয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পূর্বিতা চাকমা নৌকায় চড়ে পানিবন্ধি মানুষের মাঝে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন। একই সাথে আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেয়া হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সহজে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে পারছেননা দূর্গত এলাকার মানুষ। 

ঈদগাঁও প্রতিনিধি আনোয়ার হোসাইন জানিয়েছেন, ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ, পোকখালী এ দুটি ইউনিয়নের মানুষ প্রতিবারই বন্যা পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। সোমবার পানি বাড়লেও মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে পানি কমতে শুরু করেছে।
জালালাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ওসমান সরওয়ার ডিপু বলেন, কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্ধি হলেও খাবার ও পানি নিয়ে তেমন কোন সমস্যায় পড়তে হচ্ছেনা। সাধারণ মানুষ তাদের পাশে দাড়িয়েছে।

রামু প্রতিনিধি কপিল উদ্দিন জানিয়েছেন, রামু উপজেলার, ফতেখারকুল, কাউয়ারখোপ, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, রাজারকুল, কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া, ফতেখাঁরকুল, রশিদনগর, জোয়ারিয়ানালা ১১টি ইউনিয়নে দশ হাজারের বেশী বসত বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্নস্থানে পাহাড় ধ্বস, দেয়াল ধ্বস, গাছপালা পড়ে একাধিক বসত ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

উপজেলা প্রশাসন এবং প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে মাইকিং করে এলাকার জনসাধারণকে বর্ষণের ফলে সৃষ্ট বন্যা, জলাবদ্ধতা ও পাহাড় ধ্বস থেকে জানমাল রক্ষায় সচেতন করা হচ্ছে। 

বর্ষণের ফলে কৃষকদের সদ্য রোপন করা বিপুল রোপা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের মৌলভীপাড়ায় বন্যার পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে সৌদী প্রবাসী মৌলভী ওবাইদুল হকের ২ বছর বয়সী শিশু সামিয়া। 

সোমবার বিকাল ৫টার দিকে ওই এলাকার শিশু কন্যা বর্ষণের ফলে জমে থাকা পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। পাহাড়ী ঢলে রামুতে বাঁকখালী নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। 

রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাহমিদা মুস্তফা জানান, যেসব এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে সেখানে শুকনো খাবার ও পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেট বিতরন করেছি। প্রশাসনের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে কাজ করছে।