কক্সবাজারে তিন দিনের ভারী বর্ষণে উখিয়া-টেকনাফ উপজেলায় ১৫ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি-চিংড়ি ঘের। ঘটেছে মা-মেয়ের প্রাণহানিও। পাহাড়ি তলদেশে ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরতদের সরিয়ে নিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন।
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো: আমির জাফর বলেন, সোমবার সাড়ে ৫টার দিকে পানবাজপার এলাকার ৯-এর এ/৬ ব্লকের পাহাড়ের পাশে রোহিঙ্গা আনোয়ার ইসলামের শেডের ওপর পাহাড় ধ্বসে পড়ে। এতে আনোয়ার ইসলামের স্ত্রী জান্নাত আরা (২৮) ও মেয়ে মাহিম আক্তার (২) মারা যায়। আনোয়ার ইসলামও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মা-মেয়ে দু’জনকেই মৃত ঘোষণা করেন।
রাজা পালং ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে অতি বৃষ্টির ফলে পাহাড় ধ্বসে হতাহতের ঘটনা ঘটে। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের সমন্বিত প্রচেষ্টায় পাহাড় ধ্বস রোধে ঐক্যবদ্ধভাবে সকলকে কাজ করতে হবে।
উখিয়া ঘিলাতলীপাড়া এলাকার জসিম উদ্দিন বলেন, জলাবদ্ধতার হাত থেকে পোস্ট অফিসসহ উখিয়াবাসীর নিস্তার মিলছে না কিছুতেই। বৃষ্টির কারণে তলিয়ে গেল উখিয়া পোস্ট অফিস ও উপজেলার বিভিন্ন নিচু এলাকা।
সিকদারবিল এলাকার মুরগি বিক্রেতা আব্দুল করিম বলেন, ‘পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে টিন দিয়ে মাটির ঘর তৈরি করেছিলাম। প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে ও আমার প্রতিবেশী মাস্টার কামাল উদ্দিন পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা না রাখায় এবং উচু করে বাধ দেয়ায় পানিতে আমার মাটির ঘর ভেঙে গেছে। থৈ থৈ পানিতে আমার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। আমি আর এই ঘর তৈরি করতে পারবো না। এখন আমি অন্যের বাড়িতে রাত্রি যাপন করছি। মুরগি আর কবুতর বিক্রি করে কোন রকমে সংসার চালাই। আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। কোন জনপ্রতিনিধি আমাকে দেখতে আসেনি। পানির তোড়ে আমার মাটির ঘর সম্পূর্ণ তলিয়ে গেল। আমি প্রশাসনের সহযোগীতা কামনা করছি।’
সোনাইছড়ি এলাকার জাফর আলম বলেন, রেজু খালের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জালিয়া পালং ইউনিয়নের সোনাইছড়ি গ্রামের প্রতিটি বাড়ি-ঘরের ওঠানে পানি উঠে যায়। ডুবে যায় সোনাইছড়ি এলাকা।
রত্না পালং ইউনিয়নের সর্দারপাড়া গ্রামের নুরুল আলম বলেন, উচু এলাকায় পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা রয়েছে এবং নিচু এলাকায় পানি ওঠানে ও বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করেছে। নিচু এলাকার অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ঘর থেকে কেউ বের হচ্ছেন না। সব মিলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই বলেও জানান তিনি।
উখিয়ার রাজাপালং, রত্নাপালং, হলদিয়া পালং, জালিয়া পালং ও পালংখালী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
তৎ মধ্যে জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানীতেই ৮ হাজার মানুষ পানি বন্দি হয়ে আটকে থাকার খবরে পেয়ে ছুটে যান উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এমপি আবদূর রহমান বদি।
এসময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখে দ্রুত পানি সরানোর ব্যবস্থা করার জন্য জালিয়াপালং ইউনিয়ন আ'লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ সিকদারকে ৫০ হাজার টাকা প্রদান করে তাৎক্ষণিক কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে আরো ৫ লাখ টাকা ঘোষণা দেন।
বদি বলেন, উখিয়া-টেকনাফে অনেক বড় বড় জনদরদী নেতাকে দেখা যায় বড় বড় কথা বলতে। কিন্তু দুঃসময়ে ওইসব নেতা এখন কোথায়? এখনো তাদের ঘুম এখনো ভাঙ্গেনি। এসময় তিনি ইনানী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে জমে থাকা রাস্তার উপর পানি নিস্কাসনের জন্য রাস্তার পাশে নিজস্ব অর্থায়নে ড্রেন করে দেওয়ার ঘোষনা দেন এবং পানি বন্দী ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
জালিয়াপালং ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন সিকদার বলেন, কোষ্টগার্ডের অপরিকল্পিত মাটি ভরাটের কারণে আজকে ইনানীর মানুষ পানি বন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। পানি বন্দি মানুষের কথা আমি উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদিকে জানালে তিনি কালক্ষেপণ না করে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ইনানীতে ছুটে আসেন।
জালিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শামশুল আলম বলেন, কোষ্টগার্ডের মাটি ভরাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থা না করে অপরিকল্পিত বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে অতি বৃষ্টি হওয়ায় জোয়ারে পানি উপরে উঠলে পাহাড়ি ঢল নামতে না পারায় এলাকাগুলো পানি বন্দি হয়ে যায়। ইনানীর অধিকাংশ সুপারি বাগান ও অনেক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, বিপদের সময় বারেবারে মতো সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়না। বারংবার তিনিই ছুটে আসেন আমাদের বিপদ-আপদে। বদির সাথে কারো তুলনা হয়না।
এই দিকে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভী বাজার, ওয়াব্রাং, চৌধুরী পাড়া, রঙ্গিখালী লামার পাড়া, সাবরাং ইউনিয়নের পতে আলী পাড়া, বাহারছাড়া পাড়া, কুড়া বুইজ্জ্যাপাড়া, মুন্ডার ডেইল পাড়া গ্রামের বসবাসকারী আড়াই হাজার পরিবারের পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি টেকনাফ পৌরসভার ১২টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে ২০ হাজার মানুষ। ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে এসব মানুষের নতুন করে প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পুরাতন পল্লানপাড়া পাহাড়ের তীরে বসবাসকারী মো: জোবাইর বলেন, ‘টানা বৃষ্টির কারণে ভয়ে আছি। এ সময়ে নির্ঘুম রাত কাটে। অন্য সময় তেমন একটা ভয় কাজ করে না। তাছাড়া দুপুর থেকে এখান থেকে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে।’
ভারী বর্ষণের পারিবন্দি হয়ে পড়েছেন রঙ্গিখালী লামার পাড়ার বাসিন্দার আয়েশা বেগম।
তিনি বলেন, ‘বাড়িতে পানি ঢুকেছে, ফলে ঘরের সবকিছু পানিতে তলিয়ে গেছে। সকাল থেকে শুধু চনামুড়ি খেয়ে দিন পার করছি। কেউ আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি। আমাদের আশপাশের ৩৫টি পরিবার রয়েছে। সবার ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। মূলত স্লুইচ গেটের কারণে আমরা সবাই পানিবন্দি।’
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ভারী বর্ষণে আমার এলাকার চারটি গ্রামের দুই হাজার পরিবারের সাড়ে চার হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মূলত সীমান্ত সড়কের স্লুইচ গেইট থেকে বৃষ্টির পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে বের হতে না পারায় এসব এলাকা পানিবন্দি হয়ে পড়ে। আমরা তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি।’
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওর্য়াডের সদস্য মো: সেলিম বলেন, ‘ভারী বর্ষণের কারণে আমার এলাকায় প্রায় দেড়শ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ড্রেন-খাল দখলের কারণে পানি চলাচলের জায়গা বন্ধ হয়ে পড়েছে। যার কারণে এসব মানুষের এ করুন দশা।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: কামরুজ্জামান বলেন, ‘ভারী বর্ষণে কয়েকটি গ্রাম মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমরা তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। পাশাপাশি অতিভারী বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসের সম্ভবনা রয়েছে। তাই সকাল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাকারীদের অন্যত্রে সরে যেতে বলা হচ্ছে। তারা আশ্রয়কেন্দ্র চলে গেলে পাহাড় ধ্বসে প্রাণহানি থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়া পাহাড়ে পাড়দেশে বসবাসকারী জান-মালের রক্ষায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) সদস্যরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রেখেছি।’