পাঁচ শতাংশ জমির ড্রাগন চাষে বছরে আয় লাখ টাকা

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ১৭:২৫ | অনলাইন সংস্করণ

  নকলা (শেরপুর) প্র্রতিনিধি

পরিকল্পিতভাবে মেধা খাঁটালে এবং উপযুক্ত সময়ে শ্রম দিলে যেকোন কাজে সফলতা আসে, আসে সংসারে সুখ-শান্তি। এমন একজন কৃষক হলেন শেরপুরের নকলা উপজেলার টালকী ইউনিয়নের চরকামানির পাড়া এলাকার আজিজুল ইসলাম।

সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত কর্মচারী আজিজুল ইসলাম ২০১৮ সালে বিভিন্ন পত্রিকায় ড্রাগন ফলের চাষে সফলতা দেখে তিনি চাষে আগ্রহী হন। ২০১৯ সালে ময়মনসিংহ হর্টিকালচার সেন্টার থেকে এক ফুট উচ্চ বিশিষ্ট ৬৫টি কাটিং চারা প্রতিটি ৩৫ টাকা করে এনে বাড়ির পাশের ৫ শতাংশ জমিতে রোপন করেন। জমি তৈরী, চারা ক্রয়, সার ও কংক্রিটের খুঁটিসহ সবমিলিয়ে খরচ হয়েছিলো ৬৫ হাজার টাকা। পরের বছর ২০২০ সাল থেকে ফলন দেওয়া শুরু হয়। এলাকায় প্রথম বারের এই ফলের চাষ হওয়ায় স্থানীয়দের আগ্রহ বেড়ে যায়।

পরিবার পরিজন, প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনদের খাবারের জন্য দেওয়ার পরেও ওই বছর তিনি ড্রাগন বিক্রি করে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। এর পরের বছর থেকে পর্যায়ক্রমে ফলন বাড়তে থাকায় তার আয়ও বাড়তে থাকে। ২০২২ সালে তিনি এক লাখ ১২ হাজার টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেন। এতে খরচ বাদে ২০২২ সালে তার লাভ হয়েছিলো ৯৪ হাজার টাকা। এবছর প্রথম ধাপে ৩২ হাজার টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করেছেন। তিনি আশা করছের এবছর আরো অন্তত ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকার ড্রাগন বিক্রি করতে পারবেন।

আজিজুল হকের বাগান সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, চারিদিকে সবুজের সমারোহ। ড্রাগন ফল ছাড়াও তার বাগানে মাল্টা, পেয়ারা, বারোমাসি আম, লটকন, লেবু, বরই, কলাসহ কয়েক প্রজাতির ফল রয়েছে। প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতার প্রতিটি কংক্রিটের খুঁটি পেঁচিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাগন ফলের গাছ। প্রতি গাছে ঝুলছে পাঁচ থেকে সাতটি করে কাঁচা, পাকা ও আধা পাকা ড্রাগন ফল, ঝুলছে অগণিত ফুল। এছাড়া তার খামারে আছে হাঁস, মুরগি, কবুতর, ছাগল। রয়েছে বিভিন্ন শাক-সবজি। তিনি এই খামারটির নাম দিয়েছেন ‘আজিজুল অ্যাগ্রো ফার্ম’।

২০২২ সালের শেষের দিকে নতুন করে আরো ৫ শতাংশ জমিতে ড্রাগন ফলের বাগান সম্প্রসারণ করেছেন। সেখানে নিজের বাগানের কাটিং করা ৩৫টি চারা রোপন করেছেন। এবছর এরই মধ্যে ২-৩ টি গাছে ২-১ টি করে ফল এসেছে। আগামীতে প্রতিটি গাছে ৭ থেকে ১০ টি করে ফল আসতে পারে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করছেন।

আজিজুলের সফলতা দেখে এ ফল চাষে অনেক কৃষক আগ্রহী হয়েছেন। এরমধ্যে সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছেন পাঠাকাটার ইব্রাহিম খলিল ও কেরামত আলীসহ অনেকে। গভীর সম্ভাবনা দেখে সৌখিন চাষীদের পাশাপাশি স্বাবলম্বী হতে বাণিজ্যিক ভাবে চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অনেক চাষি। চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের রামপুর এলাকার রফিকুল ইসলাম ও বন্ধটেকী এলাকার শাহ মো. মোফাখখারুল ইসলাম নয়নসহ আরো অনেকে। এছাড়া বানেশ্বরদী ইউনিয়নের পোলাদেশী, ছোট মোজার, বড় মোজার, বাউসা এলাকার অনেকে ড্রাগন চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন।

ড্রাগন চাষীদের মধ্যে শাহ মো. মোফাখখারুল ইসলাম নয়নের বাগানটি জেলার সব বাগানের চেয়ে বড়। ২০২০ সালে গনপদ্দী এলাকায় ৬০ শতাংশ জমিতে এক হাজার ৬০০ টি কার্টিং চারা রোপন করেছেন। এসব গাছের মধ্যে থাইরেড, ভিয়েতনামি রেড, বারি ওয়ান ড্রাগন, ভিয়েতনামি হলুদ, ভিয়েতনামি সাদা, ভিয়েতনামি গোলাপি ড্রাগনসহ বিভিন্ন প্রজাতির ড্রাগন রয়েছে। ২০২২ সাল থেকে অনেক গাছে ফলন আসা শুরু হয়। এই বাগানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শাহী ড্রাগন গার্ডেন’। মোফাখখারুল ইসলাম নয়ন জানান, কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পরলে আগামী ২-৩ বছর পর হতে তার বাগান থেকে বছরে ৬ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব হবে।

তিনি জানান, খুচরা হিসেবে আকার ও রঙের ভিত্তিতে প্রতি কেজি ড্রাগন ফল ৩০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা করে এবং পাইকারি প্রতি কেজি ২৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিটি কাটিং করা চারা আকার অনুযায়ী ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা করে বিক্রি হয় বলে তিনি জানান।

এ ফল চাষে সফলতা দেখে এরইমধ্যে ভূরদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার ২৫ জন সদস্য কৃষক ২-৪ টি করে ড্রাগন গাছের কাটিং চারা সংগ্রহ করে বাড়ির আঙ্গিনায় রোপন করেছেন। এসব গাছে ফলন আসা শুরু হয়েছে। তাতে নিজেদের চাহিদা পুরন হচ্ছে বলে চাষীরা জানান।

কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোহাম্মদ শাহীন রানা জানান, ক্যাকটাস গোত্রের এই ড্রাগন ফল গাছে রাতে ফুল ফুটে এবং সুগন্ধ ছড়ায়, তাই একে নাইট কুইন বলা হয়। ড্রাগন ফলের চাষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের পরামর্শসহ সকল প্রকার সহযোগিতা দিচ্ছে বলে তিনি জানান।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী জানান, উচ্চ গুণ সম্পন্ন ড্রাগন ফল চাষে সৌখিন কৃষকের পাশাপাশি সকল শ্রেনির কৃষকদের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। প্রায় সব ধরনের মাটিতে চাষ করা গেলেও, বেলে দোঁ-আশ মাটি ড্রাগনফল চাষের জন্য উত্তম। তিনি আরো জানান, উচ্চ ফলনশীল বাউ ড্রাগন-১ ও বাউ ড্রাগন-২ বানিজ্যিক ভাবে চাষের জন্য উপযোগী। এছাড়া বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া থাইরেড, ভিয়েতনামি রেড, বারি ওয়ান ড্রাগন, ভিয়েতনামি হলুদ, ভিয়েতনামি সাদা, ভিয়েতনামি গোলাপি ও আমেরিকান হলুদ ড্রাগনে চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এ ফলের চাষ বাড়াতে কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বাড়ীর আঙ্গীনা ও পতিত জমিতে ড্রাগন ফল চাষ করে যেকেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে জানান কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী।