লোকসানের মুখে বহুল আলোচিত পৌর গ্রীণ টাউন সার্ভিস
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৩, ১৫:১২ | অনলাইন সংস্করণ
ফেনী প্রতিনিধি
লোকসানে পড়ে বন্ধ হয়ে গেল ফেনী পৌর এলাকায় গরীবের পরিবহন হিসেবে পরিচিত গ্রীণ টাউন সার্ভিস। ২নং রুটে চালু থাকলেও প্রায় সাত/আট মাস ধরে ফেনী ১নং রুটে বন্ধ রয়েছে গ্রীণ টাউন সার্ভিস পরিবহন। এই গণপরিবহন না থাকায় তেমন ভোগান্তি সৃষ্টি না হলেও যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে চলাচল করায় এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন তীব্রভাবে।
জানা যায়, পৌর এলাকায় বাস ও সিএনজির ভাড়া সমন্বয়হীনতা। অনুমোদনের চেয়েও অবৈধ উপায়ে অতিরিক্ত সিএনজি প্রবেশ এবং ট্রাফিক পুলিশ সেগুলোর তদারকি না করা। অবৈধ টমটম ও অটোরিকশা। গাড়ির পার্টসের দাম বৃদ্ধি ও বাস শ্রমিক সংকট। এ সকল সংকট ছাড়াও তেল ও গ্যাসের দ্বিগুণ দাম বৃদ্ধি হওয়ায় দিয়ে থুয়ে শ্রমিক ও মালিকের জন্য কিছুই থাকে না। একাধিক বাসমালিক ও চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন শুধু লালপোল থেকে হাসপাতাল মোড় রুটে টাউন সার্ভিসের বাস চলছে। বাসের সংখ্যাও আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে। যেগুলো চলাচল করছে সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ে-শাদি ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। শহরে বাস সার্ভিস এখন বন্ধের পথে।
গ্রীণ টাউন সার্ভিসে ট্রাংক রোড থেকে মহিপালের একসময়ের নিয়মিত যাত্রী ওমর ফারুক। আজও ট্রাংক রোড থেকে মহিপাল যাবেন তিনি। এই রুটে টাউন সার্ভিসে ভাড়া পাঁচ টাকা। কিন্তু টাউন সার্ভিস না থাকায় তিনি যাচ্ছেন সিএনজি চালিত অটোরিকসায় ১০ টাকা ভাড়ায়। ওমর ফারুক বলেন, এই রুটে টাউন সার্ভিস বন্দ হওয়ায় খুব ভোগান্তি পোহাচ্ছি এমন নয়। সিএনজি এভেইলএবল পাওয়া যায়। ভাড়া একটু বেশি আরকি। তবে টাউন সার্ভিসটা চালু থাকলে ভালো হতো। দাগনভূঞা থেকে ফেনী এসেছেন গিয়াস উদ্দিন। মহিপাল থেকে ফেনী শহরে আসার সময় টাউন সার্ভিস পাননি। অগত্যা তাকে সিএনজিতে আসতে হয়েছে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে। এবার ফেরার পথে ট্রাংক রোডের মাথায় টাউন সার্ভিসের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কোনো টাউন সার্ভিস পচ্ছেন না। গিয়াস জানান, অনেকক্ষণ ধরে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। বাস নেই। ফেনীতে আসার সময়ও পাইনি। সিএনজিতে ভাড়া অনেক বেশি। বাস থাকলে যাতায়াতে খরচ অনেক কম হতো। বিশেষ করে মহিপাল থেকে সদর হাসপাতাল যেতে আমাদের অনেক সুবিধা হতো।
শিক্ষার্থী নুপুর চন্দ্র পাল জানান, আসলে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্য বাসটি চালু থাকা খুবই দরকার। আর কলেজ যাতায়াতে ছাত্রদের জন্য এ বাসটির প্রয়োজন রয়েছে। বিকল্প চিন্তা না করে হুট করে টাউন সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া কর্তৃপক্ষের একটি ভুল সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি। ২নং রুটের বাস চালক মো. ইসমাইল বলেন, অতিরিক্ত সিএনজির কারণে ১নং রুট যাত্রী সংকটে পড়েছে। এছাড়া আমাদের বাস এসএসকে রোডের মাথা না দাঁড়াতে দেয়া যাত্রী সংকটের অন্যতম কারণ। আরও বড় সংকট তৈরি করেছে ডিজেলের দ্বিগুণ দাম বৃদ্ধি। যার কারণে চালক ও মালিক কারোই লাভ হয় না।
বাসচালক হোসেন মিয়া বলেন, ‘দীর্ঘসময় এ বাস সার্ভিসের সঙ্গে কাজ করছি। এখন শহরে এতো অটোরিকশা যে টাউন সার্ভিস দাঁড়ানো দূরে থাক, চলাচল করারও সুযোগ পায় না।’ আরেক বাসচালক ইমাম হোসেন ইমন জানান, দুটি রুটে ৫২টি বাস চলতো। মহিপাল রুট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০টি বাসের ৬০-৭০ শ্রমিক অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। মালিকরা লোকসান গুনতে থাকায় অনেক বাস কেটে বিক্রি করে দিয়েছেন। বাসমালিক জসীম উদ্দিন বলেন, ‘বাস থেকে প্রতিদিন ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা আয় হয়। তা দিয়েই পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনোরকমে দিনাতিপাত করছি।’ লাইনম্যান হিসেবে মোবারক হোসেন বলেন, ‘একটি রুট বন্ধ হওয়ায় এখন ১৫ দিন ডিউটি করি, বাকি ১৫ দিন বেকার বসে থাকতে হয়। এ রুটে আমরা দুজন লাইনম্যান মাসে ১৫ দিন করে কাজ করি।’
গ্রীণ টাউন সার্ভিস মিনিবাস মালিক সমিতির সেক্রেটারি মো. জামাল উদ্দিন বলেন, সদর হাসপাতাল টু তেমুহানি ১নং রুটে আমাদের সকল বাস ডিজেলে চলে। এ রুটে প্রতি গাড়ি দিনে ১০ ট্রিপ মারতে খরচ হয় ২২ লিটারের অধিক ডিজেল। ২২ লিটার হিসাবে যার দাম হলো দুই হাজার চারশত বিশ টাকা। কিন্তু আমাদের আয় হয় দিনে মাত্র তিন হাজার টাকা। তাহলে এ থেকে শ্রকিমরা কী পাবে আর মালিকদের কী দেবে। আয়ের সিংহভাগ জ্বালানি খাতে ব্যয় হওয়ার কারণে মালিকরা গাড়ি বিক্রি করে দিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছে।
শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি মো. আবু বলেন, অবৈধ ও অতিরিক্ত সিএনজির কারণে টাউন সার্ভিস এখন আর যাত্রী পায় না। আমাদের ফেনীর মেয়র স্বপন মিয়াজি সাহেব বলেছিলেন ফেনী পৌর এলাকায় সম্মুখে রঙ লাগানো সিএনজি ছাড়া অন্য গাড়ি চলতে পারবে না। কিন্ত এখন অবৈধভাবে রঙ করা এবং রঙ ছাড়াও দ্বিগুণ হারে সিএনজি ঢুকে পড়েছে। এ ব্যাপারে আমরা শ্রমিক ও মালিক সংগঠন মিলে মেয়র সাহেবের অফিসে গিয়ে মৌখিক অভিযোগ জানিয়েছি। কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি। অবৈধভাবে অতিরিক্ত সিএনজি ও অটোরিকশা বন্দ না হলে আমাদের পরিবহন চালানো আর কখনোই সম্ভব হবে না। অতএব মেয়র সাহেবের কাছে আমার আকুল আবেদন তিনি যেনো এই পরিবহন খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে, আমাদের মালিক-শ্রমিকের রুটি-রুজির ব্যবস্থার দায় থেকে অবৈধ গাড়িগুলো তুলে দেন।
বাসে যাত্রী সংকটের কারণ হিসেবে সেক্রেটারি জামাল বলেন, আমাদের লোকাল গাড়িতে উঠা-নামা সর্বনি পাঁচ টাকা ধরা হয়েছে। সিএনজিতেও পাঁচ টাকা। তাহলে বাসে কেন উঠবে যাত্রীরা। যার কারণে আমাদের উঠা-নামা যাত্রীও হয় না। আবার রেলগেট থেকে অবৈধ টমটমগুলো বাকি যাত্রী নিয়ে যায়। এতে আমরা পথে পথে যাত্রী সংকটে পড়ি।
শ্রমিক সংগঠনের সেক্রেটারি বলেন, সিএনজি মালিক সমিতির সেক্রেটারি হৃদয় ভাই। আমি জানি না উনি সাংবাদিক কিনা। তবে সবাই সাংবাদিক হৃদয় বলে। আমি দেখেছি ফেনী পৌরসভা থেকে এক ধরনের টোকেন বিক্রি করা হয়। এসব গাড়ি ফেনী পৌরসভাতে ভর্তি নেই। তিনি এসব অবৈধ গাড়িগুলোকে টোকেন দিয়ে, সিএনজির সামনে পৌর অনুমোদনের রং লাগিয়ে শহরে চলাচলের উপযোগী করে তোলেন। এমনকি রং ছাড়াও গাড়ি অনুমোদন পেয়েছে। ভেতরগতভাবে উনার সাথে কেউ যোগাযোগ করলে তিনি এভাবে তার গাড়ির অনুমোদন দিয়ে দেন। ফলে দেখা যায় পৌরসভার আন্ডারে যে পরিমাণ সিএনজি থাকার কথা তার চাইতে অতিরিক্ত সিএনজি ঢুকে গেছে শহরে। ফলে টাউন সার্ভিস যাত্রী হারিয়েছে। শ্রমিক সংকটের বিষয়ে সেক্রেটারি বলেন, বাসের শ্রমিক দিনে মজুরি পায় চার’শ থেকে পাঁচ’শ টাকা। কিন্তু সে যদি সিএনজি চালায় তাহলে পাঁচ’শ টাকা জমা দিয়েও দিনে মজুরি পায় হাজার থেকে পনের’শ টাকা পর্যন্ত মজুরি পায়। তাই ওরাও এখন আর বাসে কাজ করতে চায় না। ১নং রুটে ডিজেলের বদলে গ্যাসের গাড়ি চলানো যেতে পারে কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, অই রুটে আমাদের গ্যাসের গাড়ি ছিলো না। ২নং রুট থেকে কিছু গ্যাসের গাড়ি ১নং রুটে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অতিরিক্ত সিএনজির কারণে আমাদের পোষায় না। আবার এসএসকে রোডের যে জায়গায় টাউন সার্ভিস দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে সেখান থেকে গাড়ি দাঁড়াতে বাধ্য করেছে গ্রীণ টাওয়ারের সামনে। ফলে মানুষ অতদূর হেটে গিয়ে বাসে উঠতে চায় না। ২নং রুটে কিভাবে পোষায় জানতে চাইলে সেক্রেটারি জামাল বলেন, লালপোল থেকে আমাদের কিছু ডাইরেক্ট যাত্রী হয়। তাতে আমাদের গ্যাসের গাড়ির খরচটা পুষে আসে।
গ্রিন টাউন সার্ভিস বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিনের বলেন, এ সার্ভিসের সঙ্গে সম্পৃক্তরা কোনোরকম জীবনযাপন করছেন। মহিপাল রুট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অনেকেই গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেকে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।