৭ বছরেও অধরা জঙ্গী তামিমের ১৩ সহযোগী
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ২১:১৭ | অনলাইন সংস্করণ
নারায়ণগঞ্জে প্রতিনিধি
৭ বছরেও শেষ হয়নি নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকপাড়ায় আলোচিত ‘অপারেশন হিট স্ট্রং’ নামে জঙ্গি বিরোধী অভিযানে গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড খ্যাত তামিম চৌধুরী সহ তিন জঙ্গি নিহতের মামলাটির তদন্ত। চাঞ্চল্যকর ওই মামলায় অজ্ঞাত আরো ১৩ জনকে আসামী করা হয়েছিল। তবে ৭ বছরেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ইতিপূর্বে জানিয়েছিলেন, যারা মামলার সন্দেহভাজন আসামী ছিল তাদের বেশির ভাগই অন্যান্য অপারেশনে মারা গেছে। কেউ কেউ পলাতক রয়েছে। তাদেরকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট ‘অপারেশন হিট স্ট্রং’ নামের অভিযানে গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড খ্যাত তামিম চৌধুরী সহ আরো দুইজন জঙ্গির মৃত্যুর ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলার পর ওই থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ওই ঘটনায় সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ সংশোধিত ২০১৩ এর ধারা মোতাবেক নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় ওসি আসাদুজ্জামান বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন যেখানে আসামী করা হয়েছিল নিহত জঙ্গি তামিম চৌধুরী সহ তার সঙ্গে থাকা অপর দুইজন সহ অজ্ঞাত আরো ১৩ জনকে। পরে পুলিশ হেড কোয়ার্টারের আইজিপির নির্দেশে ২০১৬ সালের ৫ নভেম্বর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। মামলার তদন্তভার পেয়ে ১০ নভেম্বর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এরপর কয়েক বছর পর্যন্ত মামলার তদন্তকারী সংস্থা ছিল পিবিআই। শুরুর দিকে মামলার মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের এক পরিদর্শক থাকলেও প্রায় ৩ বছর ধরে মামলাটি প্রধান কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা তদন্ত করছেন। নারায়ণগঞ্জের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামান বুলবুল জানান, মামলার চার্জশীট এখনো আদালতে দাখিল করা হয়নি। যেকারণে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। মামলাটির সর্বশেষ অবস্থা জানতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার এর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল ধরেননি।
সেই ঘটনা
নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকপাড়া বড় কবরস্থান সংলগ্ন সড়কের শেষ প্রান্তের ৪১০/১ নাম্বারের তিনতলা আবাসিক ভবন দেওয়ান বাড়ি সদর ও ফতুল্লা মডেল থানার সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। দেওয়ান বাড়ির তিনতলা ভবনের চারিপাশে রয়েছে অন্তত ২২টি টিনশেড ঘর। যেগুলোতে বসবাস করতেন খেটে খাওয়া কর্মজীবী মানুষেরা। ছিমছাম বাড়িটির তৃতীয় তলার উত্তর দিকের ফ্ল্যাটে দেশের দুর্ধর্ষ জঙ্গি গুলশান হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ তামিম যে আস্তানা গেড়েছে তা ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি ভবনটির মালিক ও এলাকাবাসী। ২০১৬ সালের ২ জুলাই মুরাদ ও রানা নামের দুইজন যুবক নিজেদের ওষুধ কোম্পানী ‘একমি ল্যাবরেটরিজ’ এর কর্মকর্তা পরিচয় ও আইডি কার্ড দেখিয়ে ৭ হাজার টাকায় তিন তলার উত্তর পাশের ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। ওই বছরের ২৭ আগস্ট জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানোর সময় গুলশান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি তামিম চৌধুরী (৩০) গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে পুলিশ দাবি করে আসছিল। তাকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণাও ছিল। সকাল ৯টা ৩৫ মিনিট হতে ১০টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত টানা এক ঘণ্টার অভিযান ছিল বেশ শ্বাসরুদ্ধকর।
যেভাবে শুরু অপারেশন হিট স্ট্রং : ২৭ ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে গ্রেফতার হওয়া আকরাম সালাউদ্দিন নামের এক জঙ্গির তথ্যের ভিত্তিতে ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে ‘অপারেশন হিট স্ট্রং ২৭’ পরিচালনা করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ইউনিটের সদস্যরা। অভিযান শুরুর আগে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহŸান জানানো হয়েছিল জানিয়ে তারা বলেন, তাতে সাড়া না দিয়ে উল্টো জঙ্গিরা গুলি ও গ্রেনেড ছুড়েছিল পুলিশকে লক্ষ্য করে। প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে জঙ্গিদের আত্মসমর্পনের চেষ্টা করানো হয়। কিন্তু তারা গুলি ছোড়ে। জবাবে পুলিশ সদর দফতর, নারায়ণগঞ্জ পুলিশ টিম ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট একযোগে অভিযান শুরু করে। জঙ্গিদের হাতে মোট ৬টি গ্রেনেড ছিলো জানিয়ে সানোয়ার হোসেন বলেন, তারা দু’টির বিস্ফোরণ ঘটায়। ৪টি নিস্ক্রিয় করা হয়। অভিযান শেষে ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, একে-২২ রাইফেল ও অন্যান্য সামগ্রী উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, জঙ্গিদের কাছে মোট ছয়টি গ্রেনেড ছিল। এর মধ্যে দুটি গ্রেনেড তারা পুলিশকে লক্ষ করে ছুড়ে মারে। দুটি গ্রেনেড পুলিশ নিষ্ক্রিয় করেছে। আর দুটি গ্রেনেড পাশের একটি টিনের চালের ওপর পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
পাইকপাড়ায় অপারেশন ‘হিট স্ট্রং-২৭’ শুরুর আগে জঙ্গিরা সব নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলে। পুলিশ জানায়, অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে জঙ্গিরা সব নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলে।
আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, ‘পাইকপাড়া বড় কবরস্থান এলাকার তিনতলা ওই ভবনের তৃতীয় তলাতেই জঙ্গিরা অবস্থান করছিল। সকালে অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে জঙ্গি সদস্যরা তাদের সব ডকুমেন্ট ও আলামত আগুনে পুড়িয়ে ফেলে।’
পাইকপাড়ায় মুরাদ ও রানা পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গিরা। তারা বাসাটি ভাড়া নেয় জুলাই মাসে। ওই বাড়ির মালিক নুুরুদ্দিন দেওয়ান এ কথা জানিয়েছেন। পাইকপাড়ার বাড়িটি তিনতলা। জঙ্গিরা তিনতলার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয়। এই বাড়ির আশপাশে টিনের কয়েকটি বাড়ি রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের সময় পাল্টা গ্রেনেড ছোড়ে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা। সেসময় ‘নারায়ে তাকরিব আল্লাহু-আকবর’ বলে স্লোগান দেয় তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী এ কথা জানিয়েছেন। তিন তলার ওই বাড়িতে অভিযানের সময় পাশের একটি ভবনের বাসিন্দা এই প্রতিবেদককে জানান, অভিযানের শুরুতে জঙ্গিরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। একই সময় ‘আল্লাহু-আকবর’ বলে স্লোগান দেয় তারা। অভিযানের পর পুলিশের আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেছেন, জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে রাজি না হয়ে তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর পাল্টা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
অভিযান পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা জানান, গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পর নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার কবরস্থানের তিনতলা বাড়িটিতে ‘অপারেশন: হিট স্ট্রং ২৭’ পরিচালনার ছক তৈরি করা হয়। জঙ্গিরা যেন পালাতে না পারে, সে জন্য আগে থেকেই ঘটনাস্থলের চারপাশ ঘিরে রাখেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটসহ পুলিশের অন্য টিমের সদস্যরা। আইজিপির নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হলেও তারা সেই সুযোগ নেয়নি। উপরন্তু তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে একের পর এক গ্রেনেড ছুড়ে মারে। একইসঙ্গে এ কে ২২ রাইফেল দিয়ে গুলি করতে থাকে। এরপর পুলিশও পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিযান শুরু করে। অভিযানে থাকা সোয়াত টিমের সদস্যরা অন্যান্য অস্ত্রের সঙ্গে স্নাইপার রাইফেলও ব্যবহার করেন। অভিযানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্নাইপার রাইফেল দিয়ে টেলিস্কোপের সাহায্যে নির্ভুলভাবে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে গুলি করা সম্ভব হয়। এই রাইফেল দিয়ে দ্রæত শক্তিশালী বুলেট ছোড়া যায়। ছবিও তোলা যায় স্নাইপার রাইফেলের টেলিস্কোপ দিয়ে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা স্নাইপার রাইফেল ব্যবহার করেছিলেন। তবে সেখানে স্নাইপার রাইফেল দিয়ে কেবলমাত্র জঙ্গিদের ছবি তোলা হয়েছিল, গুলি চালানো হয়নি। যে কারণে নারী ও শিশুসহ বেশ কয়েকজনকে জীবিত ও অক্ষত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। কয়েক রকমের স্নাইপার রাইফেল রয়েছে। তবে, ঠিক কোন ধরনের স্নাইপার রাইফেল পাইকপাড়ায় ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা জানাননি সংশ্লিষ্টরা।
তামিম চৌধুরী সহ তিন জঙ্গির মৃত্যুর ঘটনায় বাড়ি ভাড়া দেয়া ভবন মালিক নূরউদ্দিন দেওয়ানকে (৬৭) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছিল পুলিশ। পরে দীর্ঘদিন কারাভোগ শেষে ওই বছরের ১১ অক্টোবর তিনি জামিন পান। দীর্ঘ ৭ বছরেও মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় আক্ষেপ করেছেন বাড়িওয়ালা নূর উদ্দিন দেওয়ান। ৭ বছর পূর্বে জঙ্গীদের দমনে সেই অভিযানের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে এখনো আঁতকে উঠেন তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, একটি ভুলের মাশুল গুনছেন গত ৭ বছর ধরে। পুলিশের রিমান্ড শেষে দীর্ঘদিন কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পেলেও মামলা থেকে রেহাই মিলছেনা তার। দুই আড়াই মাস পরপরই তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। জঙ্গীবাড়ি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় সেই ফ্ল্যাটটিতেও বেশীদিন ভাড়াটিয়া থাকছেনা।
নূর উদ্দিন দেওয়ান আরো জানান, তিনি সরকার ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি যখন ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়েছিলেন তখন তামিমসহ যারা নিহত হয়েছে তাদেরকে দেখেননি। আর যারা ভাড়া নিয়েছিল তারা তাদের পরিচয়পত্র দেখিয়েছিল। তাদের পরিবার নিয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু পরিবার নিয়ে না ওঠায় তিনি ফ্ল্যাটটি খালি করে দেয়ার নোটিশও দিয়েছিলেন। যদি তার চোখে কোন ধরনের অসঙ্গতি ধরা পড়তো তাহলে তিনি তাৎক্ষণিক পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করতেন।
তিনি আরো বলেন, গত ৭ বছর ধরেই তাকে দুই আড়াই মাস পর পর আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার জন্য তিনি অসংখ্যবার তদন্তকারী সংস্থাকে ও আইনজীবীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। করোনার আগে আইনজীবীকে মামলাটি শেষ করার জন্য ২৫ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, জঙ্গীরা যে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিল সেটি দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ ছিল। পরে পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে তালার চাবি বুঝে পেয়ে সংস্কার করে ভাড়া দিয়েছেন। তবে ওই ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়া বেশীদিন থাকতে চায়না। যারাই ভাড়া নেয় যখন জানতে পারে এই ফ্ল্যাটে ওই ঘটনা ঘটেছিল তখন কয়েক মাস থেকে তারা অন্যত্র চলে যায়।