ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

টাঙ্গাইলে বাড়ছে পানি- চলছে ড্রেজার- ভাঙছে ঘরবাড়ি

টাঙ্গাইলে বাড়ছে পানি- চলছে ড্রেজার- ভাঙছে ঘরবাড়ি

টাঙ্গাইলে হু হু করে পানি বেড়ে তিনটি নদীর বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আরও দুইটি নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। পানি বাড়লেও অনবরত ড্রেজার চালানোর কারণে নদীতীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এক সপ্তার ব্যবধানে শতাধিক ঘরবাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড(পাউবো) এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে মাটি দেওয়ার শর্তে নিউ ধলেশ্বরী নদীতে ড্রেজার চালানোর অনুমতি দিয়ে আবার ভাঙন কবলিত অংশে জিওব্যাগ ফেলে পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। ফলে স্থানীয়দের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

পানি বৃদ্ধির সময়ও নিরবচ্ছিন্নভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে কালিহাতীর নিউ ধলেশ্বরীর দুই তীরের কুর্শাবেনু, গোবিন্দপুর, কদিমহামজানী, চরহামজানী, দশকিয়া, সল্লা, হাতিয়া, আনালিয়াবাড়ী, টুনিমগড়া, ধলাটেঙ্গর, কুড়িঘরিয়া, চরভাবলা, হিজুলী, এলেঙ্গা, বাশী এবং যমুনার তীব্র স্রোতে বাম তীরে ভূঞাপুরে কষ্টাপাড়া, পাটিতাপাড়া, গোবিন্দাসী, খানুরবাড়ী, জিগাতলা, কুঠিবয়ড়া প্রভৃতি গ্রামের ঘরবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বীজতলা ও ফসলি জমি ভাঙনের আশঙ্কায় রয়েছে।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি পোড়াবাড়ি পয়েণ্টে ১৬ সেণ্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১৯ সেণ্টিমিটার, নিউ ধলেশ্বরী(ঝিনাই) নদীর পানি জোকারচর পয়েণ্টে ৮ সেণ্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৫৯ সেণ্টিমিটার এবং ধলেশ্বরী নদীর পানি এলাসিন পয়েণ্টে ১০ সেণ্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৬ সেণ্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ফটিকজানী নদীর পানি নলছোপা পয়েণ্টে ৩ সেণ্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৭০ সেণ্টিমিটার ও বংশাই নদীর পানি মির্জাপুর পয়েণ্টে ৩ সেণ্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২০ সেণ্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পাউবো সূত্রমতে, এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের গোলচত্ত্বর পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার অংশ চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে মাটিভরাটের প্রয়োজন হয়। ওই সড়কে মাটি দেওয়ার শর্তে জেলা ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশে নিউ ধলেশ্বরী নদীর ৯টি স্থান থেকে ৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ড্রেজার দিয়ে মাটি-বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়। এরমধ্যে নিউ ধলেশ্বরী নদীর চরভাবলায় দুইটি পয়েণ্টে রিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স বিপুল এণ্টারপ্রাইজকে এক দশমিক ০৮ কিলোমিটার, আনালিয়াবাড়ীর ৩টি পয়েণ্টে রিফাত এণ্টারপ্রাইজ ও অ্যামনেস্টার লিমিটেডকে ২ দশমিক ১৫ কিলোমিটার, সল্লার দুইটি পয়েণ্টে রিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স তুষার এণ্টারপ্রাইজকে এক দশমিক ২০ কিলোমিটার এবং রিফাত এণ্টারপ্রাইজকে জেকারচর ও গুদারা ঘাট দুইটি পয়েণ্টে এক দশমিক ৪৫ কিলোমিটার নদী খননের অনুমতি দেওয়া হয়। উল্লেখিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে পুরো বর্ষায়ও ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে। তারা শর্ত ভঙ্গ করে উত্তোলিত বালু ট্রাক দিয়ে চারলেন প্রকল্পে সরবরাহ না করে কালিয়াকৈর ও গাজীপুর সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছে।

অপরিকল্পিত নদী খনন অব্যাহত রাখায় বেলটিয়া গুদারাঘাট পাউবোর অধিগ্রহনকৃত জায়গার ১৫০ মিটার ও কদিমহামজানী এলাকার ৬০ মিটার জায়গায় ইতোপূর্ব ফেলা জিওব্যাগ ধসে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ওই দুই স্থানে পুনরায় পাউবো মেসার্স বিপ্লব এণ্টারপ্রাইজ ও আমিন ট্রেডিং নামক দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে। জিওব্যাগ ফেলা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি শহীদুল ইসলাম জানান, হঠাৎ করে জিওব্যাগ ধসে ভাঙন দেখা দেওয়ায় নতুন করে গুদারা ঘাট এলাকার ১৫০ মিটার ও কদিমহামজানী এলাকার ৬০ মিটার অংশে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।

নিউ ধলেশ্বরী নদীর বাম তীরে আনালিয়াবাড়ী ও ধলাটেঙ্গর গ্রামের হবিবর রহমান(হবি), আ. হালিম, গৃহবধূ ছবিরন বেগম, সাবিনা আক্তার, মোছা. রিনা বেগম, মো. লিয়াকত আলী, সুনীল হাওলাদার সহ অনেকেই জানান, বর্ষার ভরা মৌসুমে নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে দুই তীরেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। পাউবো একদিকে খননের অনুমতি দিয়েছে, অন্যদিকে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙনরোধের চেষ্টা করছে। তাদের এই স্ববিরোধী সিদ্ধান্তে তাদের বাড়িঘর হারাতে হচ্ছে।

তারা জানান, নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করে চারলেন প্রকল্পে না দিয়ে দিনরাত ট্রাক ভরে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করার বিষয়টি পাউবোর কর্মকর্তাদের জানালেও তারা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। নদী ভাঙনের হাত থেকে বাড়িঘর ও ফসলি জমি রক্ষায় তারা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করার পরও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নিউ ধলেশ্বরী নদীর অফটেক(নদীমুখ) থেকে পুংলি পর্যন্ত দেখভালকারী পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মজনু মিয়া জানান, নদীর ৯টি অংশে প্রায় ৫ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার এলাকায় চারলেন প্রকল্পের আবদুল মোনেম লিমিটেডের তত্ত¡াবধানে ৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ড্রেজার দিয়ে খনন কাজ করছে। ভরা বর্ষায় নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে তীরে ভাঙন দেখা দেওয়ার বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করেন নি।

তিনি জানান, গুদারা ঘাট ও কদিমহামজানীতে ভাঙন রোধে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে। আনালিয়াবাড়ী ও ধলাটেঙ্গর এলাকায়ও ভাঙন রোধে জিওব্যাগ ফেলা হবে।

এদিকে, নিউ ধলেশ্বরী নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাউবো নির্মিত সল্লা-হাতিয়া নদীরক্ষা বাধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাধটি যাতে কেউ কেটে দিতে না পারে সেজন্য সল্লা ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশরা পালা করে পাহাড়া দিচ্ছেন। দশকিয়া ইউনিয়নের বালিয়াচরা-পটল বাজার গ্রাম্য রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। দুর্গাপুর ইউনিয়নের চর দুর্গাপুর, বেরীপটল, ভৈরববাড়ী, বেলটিয়া ও আলিপুর গ্রামে পানি ঢুকে বাড়িঘর ও ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।

সল্লা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম জানান, সল্লা-হাতিয়া বাধ প্রায় প্রতি বছরই কে বা কারা রাতের অন্ধকারে কেটে দেয়। এবারও যাতে বাধ কাটতে না পারে সেজন্য গ্রাম পুলিশ দিয়ে পালা করে দিনরাত পাহাড়ার ব্যবস্থা করেছেন। তবে যে হারে পানি বাড়ছে এতে যেকোন সময় বাধটির উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে পারে। দশকিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক ভূঁইয়া জানান, নিউ ধলেশ্বরী নদীর পানি বেড়ে তার ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম্য রাস্তা, ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। আমন বীজতলাও তলিয়ে গেছে।

চারলেন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. রবিউল আউয়াল জানান, প্রকল্পে প্রচুর বালু-মাটির প্রয়োজন হওয়ায় জেলা ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটেরিয়াল ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে তারা নিউ ধলেশ্বরী নদীর ৯টি স্থানে খনন করে বালু-মাটির সংস্থান করেছেন। সেখানে ৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বালু উত্তোলন করে প্রকল্পে সরবরাহ করছে। অন্য কারো কাছে উত্তোলিত বালু বিক্রি করার অধিকার তাদের নেই।

টাঙ্গাইল,ভাঙছে,ড্রেজার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত