সোনালী পাটের হাসি হাটে শেষ

প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:১৫ | অনলাইন সংস্করণ

  আব্দুর রহমান মিন্টু, রংপুর

চলতি মৌসুমে পুরোদমে শুরু হয়েছে পাটকাটা ও আঁশ ছাড়ানোর কাজ। পাট মন্ত্রণালয় থেকে সার, বীজ, কীটনাশকসহ নানা সহযোগিতা দেয়া হলেও রংপুরে দিন দিন কমে যাচ্ছে পাটের আবাদ। আর চলতি বছর স্থানীয় হাটগুলোতে পাটের দাম না থাকায় পুঁজি হারানোর শঙ্কায় কৃষক। খরচের তুলনায় পাটের দাম না থাকায় পাট ছেড়ে তামাক ও ভুট্টা চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরে রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারীর পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার ৫৩৭ হেক্টর।

পাটচাষিরা বলছেন, প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে পাটের আবাদ করেছেন তারা। তবে উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পাটের দাম কমানোর কারণে লোকসানের মুখে পড়ছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বাজার মনিটরিং করাসহ পাটে ভর্তুকি দিতে সরকারের সুনজর প্রয়োজন বলে মনে করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।  

বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানির অভাবে সেচের মাধ্যমে পাট জাগ দেওয়ার স্থানগুলোতে পানি জমিয়ে জাগ দিচ্ছেন অনেকেই। এতে বাড়তি খরচের চাপ সইতে হচ্ছে তাদের। পাট জাগে হেরফের হলে এবং পরিষ্কার পানি না থাকলে মানসম্মত পাট পাওয়া সম্ভব হবে না। একারণে কেউ কেউ বিকল্প উপায়ে সেচ সুবিধায় অথবা রিবোন রেটিং পদ্ধতিতে পাট জাগ দেওয়া শেষে আঁশ ছাড়ানোর কাজ করেছেন। বর্তমানে দামের হেরফের থাকলেও পাট নিয়ে ব্যবসায়ীদের গুদামে নয়তো হাটমুখী হচ্ছেন চাষিরা।

এই প্রতিবেদককে হরিশ চন্দ্র বলেন, প্রায় এক বিঘা জমিত পাট গাড়া (রোপন করা) থাকি শুরু করি ধোয়া পর্যন্ত ১০ হাজার টাকা খরচ হইছে। এবার পাট পাইছি ছয় মণ। কিন্তু বাজারোত পাটের দাম পাই নাই। প্রতিমণ ৮০০ টাকা থাকি ১ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম। ছয় মণ পাট আবাদ করতে দশ হাজার টাকা খরচ নাগছে আর বিক্রি করছি অর্ধেক দামোত। এই বছর পাটোত মণপ্রতি হাজারের কাছাকাছি লস খাইছি বাহে।

মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ি সেরুডাঙ্গা বাজার এলাকার আলমগীর হোসেন বলেন, এক সময় আমাদের এই গ্রামে পাটের খুব আবাদ হতো। এখন লোকসানের কারণে মানুষ পাট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাটে খরচ বেশি কিন্তু লাভ নেই। অনেকেই পাটের আবাদ না করে সরিয়া, তামাক,  ভুট্টাসহ শাক-সবজি আবাদ করছে। এগুলো চাষাবাদে লোকসানের সম্ভাবনা নেই।

পীরগাছা উপজেলার পাওটানা হাটে গিয়ে দেখা যায়, কাউনিয়া, মিঠাপুকুর, পীরগাছা, পীরগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী সুন্দরগঞ্জ ও উলিপুর উপজেলা থেকে অনেক পাট চাষি এসেছেন এই হাটে পাট বিক্রি করতে। গত ২ সপ্তাহ আগে এই হাটে মানভেদে প্রতি মণ দেশি, তোষা এবং মেস্তা জাতের পাট ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মানভেদে সেই পাট বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায়। প্রতি মঙ্গল ও শুক্রবার এই হাটে  ৭০০ থেকে এক হাজার মণ পাট বিকিকিনি হয়ে থাকে।
 
হাটের মাঝখানে তপ্তরোদে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল সাজু ব্যস্ত পাটের ট্রলি বোঝাই করতে। এর ফাঁকে কথা হলে তিনি বলেন, পাটের বাজার বিগত কয়েকটি হাটের তুলনায় আজ নিম্নমুখী। গত কয়েকটি হাটে প্রতিমণ পাট ২ হাজার ১০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত ছিল। সেই পাট আজকে প্রতিমণে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে করে খুচরা ব্যবসায়ী ও পাটচাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এভাবে পাটের বাজার নিম্নমুখী হলে আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বাজারে টিকে থাকতে পারব না।

গতবছর এই হাটে প্রতিমণ পাট টোসা বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। এবার সেই দাম কমে আসাতে বিপাকে পড়েছেন প্রান্তিক চাষিরা। গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থেকে আসা ক্ষুদ্র পাটচাষি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পনেরো বছর ধরে ব্যবসা করছি। এরমধ্যে গত কয়েক বছর ধরে পাটে খুব বেশি লোকসান হচ্ছে। পাটের দাম যদি প্রতিমণে ২ হাজার ৬০০ হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত হলে কৃষকরা লাভবান হতো।  

এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরে রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারীর পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার ৫৩৭ হেক্টর। তবে কৃষকেরা ৫২ হাজার ২৫৪ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করেছেন। প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ২.৫৬ মেট্রিকটন। প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক পাট চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

অন্যদিকে রংপুর জেলায় এবার পাট চাষ হয়েছে ৯ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমিতে। তীব্র তাপদহ, অনাবৃষ্টি, রোদ এবং খরা থাকলেও বেশ কয়েকটি উপজেলায় পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবার রংপুর অঞ্চলে ৬২৭ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ বেড়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

এদিকে উন্নত মানের বীজ সরবরাহের পাশাপাশি অনাবৃষ্টিতে পাট জাগ দেয়ার দুশ্চিন্তা এড়াতে রিবোন রেটিং ও ভালোমানের পাট চাষ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে পাটের ন্যায্যমূল্যের বাজার নিশ্চিতকরণে পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে সরকারের কৃষিবিভাগ।

রংপুর অঞ্চলের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ আফতাব হোসেন বলেন, পাটের আবাদের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ কিছুটা কমে এসেছে। কারণ পাট পচানোর সমস্যা। এখন পুকুর-জলাশয় মাছ চাষের আওতায় এসেছে। ফলে মাছ চাষ করা পুকুর-জলাশয়ে পাট পচানো সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া পাট যে মৌসুমে হয় ওই মৌসুমেই অন্য ফসলে তুলনামূলক ভাবে বেশি আয় করা সম্ভব হয়। অনেকে লাভের হিসাব করে পাটের আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।