ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঝিনাইগাতীতে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি 

ঝিনাইগাতীতে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি 

কালের বিবর্তনে ঝিনাইগাতী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প। এক সময় ভোর হতেই শোনা যেতো ও ধান বানেরে ঢেঁকিতে পার দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া ও ধান বানেরে ঢেঁকিতে পার দিয়া এই গান আর ঢেঁকির ধাপুর ধুপুর শব্দ। সুখ দুঃখের গল্পের সাথে অন্তরের কথা সুতায় গেঁথে গান বলতো আর ঢেঁকিতে পাড় দিতো গ্রাম-বাংলার নারীরা।

যান্ত্রিকতার ভীড়ে সেই চিরচেনা সুরের সাথে মন চঞ্চল করা সেই গান আজ শুনতে পাওয়া ভার। মাটির ঘরের এক সাইডে দুই পাশে দুইটা কাঠ পুঁতে কাঠ দুইটার মাথার উপর আর একটা বাঁশ রাখা হয় তার উপর হাত রাখার জন্য। ঘরের মাটির ভিটা সই করে ঢেঁকির জায়গা ঠিক করা হয়। শাল গজারী গাছের কাঠ দিয়ে সোজা তৈরি করে পেছনের অংশ চ্যাপ্টা সামনের অংশ তিনকোণা করে তার নীচে সুরের মত করে তৈরি। যাকে বলা হয় আংতা বা মুষল। মুষল পড়ে গড়ের উপর। মাটিতে গর্ত করে গড় তৈরি করা হয়। গড়ের মধ্যে ধান,চাল বা শস্য দিয়ে ভিটার উপর দাঁড়িয়ে এক পা দিয়ে ঢেঁকি উঁচু করে ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া হয়। ঢেঁকি রাখার জায়গা সাধারণত পাকের ঘরই ছিল গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যর ঢেঁকিশালা। শোবার ঘর আধ-ভাঙা হলেও ঢেঁকিশালা খুব পরিপাটি করে তৈরি করতো গ্রাম-বাংলার নারীরা।

তাদের এই পরিপাটি কাজ দেখে প্রবাদও প্রচলন আছে। ‘’আসল ঘরে মুসল নাই ঢেঁকিশালা চাঁদোয়া‘’। “ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে”। অর্ন্তজালা বুঝাতে বলা হয়, বুকে ঢেঁকির পাড় পড়া। সভ্যতার ক্রমান্বয়ে এখন আর ঢেঁকি দেখাই যায় না। এমনকি যে এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি সেই এলাকায়ও ঢেঁকি শিল্প বিলুপ্তপ্রায়। এক সময় দেশের সব জেলায় ঢেঁকি দেখা যেতো। গ্রামে প্রায় সব বাড়িতেই ঢেঁকি দেখা যেতো। অভাবগ্রস্ত নারীরা জীবিকার তাগিদে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে অর্থ রোজগার করত। মাঝ রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঢেঁকিতে পাড় দিতো। ভোর বেলায় গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙত ঢেঁকির ক্যাচুর কুচুর শব্দে। গ্রামের বিত্তবানরা ঐতিহ্য হিসাবে তাদের বাড়িতে ঢেঁকি রাখতো। নতুন ধান উঠার পর ধান থেকে চাল, চিড়া বা চালের গুড়া তৈরি করতে গ্রামের অভাবগ্রস্ত নারীরা বিত্তবানদের বাড়িতে ঢেঁকি পাড় দিয়ে ধানের মন প্রতি চাল বা টাকা পেতো। আর শীত আসলে তো কথাই নেই। যেন চালের গুড়া করার ধুম লেগেছে। দুই জন নারী ঢেঁকিতে পাড় দিতো একজন এলে দিতো। এলে দেওয়া বলতে যখন ঢেঁকির আংতা গড়ের মধ্যে পরে তখন চালের গুড়াতে চাপ লেগে চাল ভাঙতে শুরু করে। তারপর ঢেঁকি উঁচু করে করে মাঝে মাঝে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়। এই নাড়াচাড়া করাকে এলে দেওয়া বুঝায়।

আর একজন সেই চালের গুড়া ছাকনি নিয়ে ছাকে। চারজন নারী ঢেঁকিতে কাজ করে। চাল গুড়া হয়ে যাবার পর সেই চালের গুড়া দিয়ে পিঠা,পায়েস,ফিরনিসহ শীতের হরেক রকমের মজার পিঠা তৈরি করত। পিঠা আর পায়েসের সেই মনভোলানো সুঘ্রাণ পড়শি বাড়ি চলে যেতো। বিকেল হলে ঢেঁকিশালায় বধূদের মেলা বসতো। একে অন্যকে ঢেঁকিপাড় দিয়ে সহযোগীতা করত। এতে করে পাড়াপড়শিদের মধ্য সুসম্পর্কও ছিল। একজনের অভাব আর একজন দেখতো। অন্যর ঢেঁকিতে ধান ভেনে চিড়াকুটে বা চালের গুড়া করে দিয়ে অভাব পুরন করার পথ ছিল। শুধু অভাবপূরণ না ঢেঁকি ছাটা চালের গুড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বলে শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ঢেঁকি ছাটা চালকে বলে ব্রাউন রাইস। ব্রাউন রাইসে আছে স্টার্চ ও ফাইবার। যা ভিটামিন বি, ভিটামিন ই ম্যাঙ্গানিজ ও সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ। কিন্তু যুগের আধুনিকায়নে যন্ত্রের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঢেঁকি শিল্প।

মেশিনেই ধান ভানাসহ চালের গুড়া করা হয়। গ্রামের অভাবগ্রস্ত নারীরা এখন ঢেঁকিতে কাজের চাহিদা না থাকায় অন্যর বাড়ি কাজ করে কেউবা অভাবের সাথেই দিন কাটায়। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলেও কয়েক গ্রাম ঘুরে ঢেঁকি শিল্পের দেখা পাওয়া ভার। অতীতে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে ঢেঁকি শিল্পের কদর ছিল শুধু শহরের লোক ঢেঁকির নাম শুনলেও তা দেখতে পেতো গ্রামে এসে বা জাদুঘরে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন গ্রামের লোকও ঢেঁকি দেখার জন্য জাদুঘরে যাবে। সময়ের সাথে সভ্যতার প্রয়োজনে আমরাই এই ঢেঁকির ব্যবহার ঘটিয়েছিলাম। যন্ত্রবিপ্লবের যুগে নিজেরাই হারাতে বসেছি সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ঢেঁকি। কয়েক গ্রাম ঘুরেও শুনতে পাওয়া যায় না ঢেঁকির ঢেঁক ঢেঁকানি শব্দ। ঝিনাইগাতী উপজেলার বেশ কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে প্রবীণদের মুখে শুনতে পাওয়া গেলো অতীতে ঢেঁকিশিল্পের কদর আর বর্তমানে ঢেঁকিশিল্পের বিলুপ্ত প্রসঙ্গে। তবে জনসচেতনতা সৃষ্টি না করলে আমাদের কাছ থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকিশিল্প।

ঝিনাইগাতী,বিলুপ্তি,ঢেঁকি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত