কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া বা বেস্টনী। ২০২০ সালে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়া, অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া এবং বিদেশ পাচার রোধকল্পে ক্যাম্পের চারপাশে দেয়া হয় এ কাঁটাতারের বেষ্টনী। কিন্তু তাতেও আটকনো যাচ্ছে না রোহিঙ্গাদের। এই কাঁটাতারের বেড়াও না মেনে ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্রে যাচ্ছে তারা। বৃহস্পতিবার ৪০ জন সহ ছয়দিনে ৪৭২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্প ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ ও এপিবিএন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের উখিয়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, আটক রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কাজের সন্ধানে বের হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার নিয়ম নেই। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্পের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তত ১০টি তল্লাশিচৌকি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু কাটাঁতারের বেস্টনী কেটে গেইট করে রোহিঙ্গারা বের হয়ে যাচ্ছে।
তিনি জানান, আটক রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পে ফেরত পাঠানোর জন্য শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এর আগে ১৬ সেপ্টেম্বর ২৯ জন, ১৭ সেপ্টেম্বর ২৯ জন, ১৮ সেপ্টেম্বর ৫৫ জন, ১৯ সেপ্টেম্বর ৬১ জন, ২০ সেপ্টেম্বর ৫৮ জনকে আটক করে স্ব-স্ব ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ। এর বাইরে এপিবিএন সদস্যরা ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০ জনকে আটক করে ক্যাম্পে ভেতর পাঠায়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশে-পাশের এলাকার মানুষ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তথ্য মতে, ক্যাম্পের বাইরে যাওয়া ঠেকাতে লাগানো কাঁটাতারের বেড়া কেটে নিজেদের মতো দু’শোর বেশি গেইট তৈরী করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা। আর নিয়ন্ত্রণহীন সেই গেইট দিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যাওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি লোকালয়ে গিয়ে অপরাধে জড়াচ্ছে তারা।
সম্প্রতি দেখা যায়, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পাশেই উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের অবস্থান। এই ক্যাম্পের চারপাশে রয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী কাঁটাতারের বেষ্টনী। কিন্তু এই ক্যাম্পের এক কিলোমিটার এলাকায় ১০টি অংশে কাঁটাতারের বেড়া কেটে তৈরি করা হয়েছে গেট। আর এসব গেট দিয়ে নিজেদের মতো করে অবাধে যাতায়াত করছে রোহিঙ্গারা।
আর কুতুপালংস্থ আম গাছ তলা এলাকায় দেখা যায়, কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে রয়েছে একটি গ্রীলের গেট। এই গেট পার হয়ে সহজে ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুরা। একই ওই গেটের পাশে রয়েছে একটি ছোট ফাঁক। ওই ফাঁক দিয়েও ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছে শত শত রোহিঙ্গারা।
ক্যাম্পের কাঁটাতারের বেড়া কেটে করা গেইট দিয়ে বের হওয়া রোহিঙ্গাদের রয়েছে নানা অজুহাতও। ক্যাম্প ২ ইস্টের বøক এ/৭ এর বাসিন্দা ওমর ফয়সাল (৩১) বলেন, ক্যাম্প থেকে বের হয়েছি কাজে যাওয়ার জন্য। রাস্তায় দাঁড়িয়েছি গাড়িতে উঠার জন্য। ক্যাম্প-২ ব্লক-বি এর বাসিন্দা মোহাম্মদ রফিক বলেন, ক্যাম্পের ভেতর থাকি। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়ার কারণে ক্যাম্প থেকে বের হতে পারি না। তাই কাঁটাতারের বেড়া কেটে যেস্থানে ফাঁক করা হয়েছে সেদিক থেকে বের হয়ে বাজারে যাচ্ছি।
কুতুপালং রেজিষ্ট্রাট ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইছহাক বলেন, কাঁটাতারের বেড়ার কারণে ক্যাম্প থেকে সহজে যাতায়াত করা যায় না। এই জন্য অনেকেই কাঁটাতার কেটে ফাঁক করেছে ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার জন্য। এখন ওই ফাঁক দিয়ে ক্যাম্প থেকে বের হয়েছি। অটোরিকশা চালাব আর কাজ-কর্ম করব।
কুতুপালং রেজিষ্ট্রাট ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা ছলমা খাতুন বলেন, কুতুপালং ক্যাম্প থেকে বের হয়েছি বালুখালী যাওয়ার জন্য। সেখানে আত্মীয়ের বাড়িতে যাব। এখন গাড়ির জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছি।
বালুখালী ক্যাম্প ৮ এর বাসিন্দা ইউসুফ বলেন, এপিবিএনের চেকপোস্ট আছে তাই কাঁটাতারের বেড়া যেদিকে কাটা ছিল ওইদিক থেকে পার হয়ে ক্যাম্প থেকে বের হয়েছি। সারাদিন উখিয়ার একটি গ্রামে কৃষি কাজ করেছি। এখন কাজ শেষে ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছি।
টিভি টাওয়ারস্থ ক্যাম্প ২ এর বাসিন্দা খায়রুল আমিন বলেন, কে বা কারা কাঁটাতারের বেড়া কেটেছে জানিনা। শুধু এখানে নয়, কিছুদূর পরপর কাঁটাতার কেটে যাতায়াতের অনেকগুলো পথ রয়েছে। এসব পথ দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছে। শুধু রোহিঙ্গা নয়; ক্যাম্পে যারা এনজিও সংস্থায় চাকুরি করেন তারাও এসব পথ ব্যবহার করে। উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, গেলো ৬ বছরে একজন রোহিঙ্গা কেউ প্রত্যাবাসন করা হয়নি। আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোন আশাও দেখছি না। এর কারণে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে যেভাবে বের হচ্ছে এটা খুবই আতংক ও উদ্বেগের বিষয়। এটা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকির বলে মনে করছি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। এভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি আরো বাড়বে। তাই সরকার, প্রশাসন, সকল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে রোহিঙ্গাদের ছেড়ে বের হয়ে যাওয়া বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ও মেরিন ড্রাইভে চেকপোস্টগুলো সচল করে নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা নাহলে রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
কক্সবাজারগামি যাত্রীবাহি বাস থেকে নামানো রোহিঙ্গা রহিম বলেন, চট্টগ্রামের দোহাজারি যাচ্ছি। ওইখানে ক্ষেত-খামারে কাজ করি। এর আগেও দোহাজারি কয়েকবার গিয়েছি কাজ করতে। কিন্তু এবার ক্যাম্প থেকে দোহাজারি যাওয়ার পথে প্রশাসন ধরে ফেলেছে।
ক্যাম্প-৩ আরেক রোহিঙ্গা ছলিমুল্লাহ বলেন, ক্যাম্প থেকে বের হয়ে রাস্তা দাঁড়ায়। তারপর ৬০ টাকা ভাড়ায় কক্সবাজারে যাওয়ার জন্য বাসে উঠি। এরপর কক্সবাজার থেকে নেমে আবার পটিয়া যাব। ওখানে শ্রমিকের কাজ করি। এর আগেও অনেকবার পটিয়ায় কাজ করতে গিয়েছিলাম।
উখিয়াস্থ ৮ এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উক্য সিং বলেন, ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে রোহিঙ্গারা নানা কৌশল অবলম্বন করছে। বিশেষ করে যাত্রীবাহি বাস, সিএনজি অটোরিকশা, ইজিবাইক যোগে কক্সবাজার সহ চট্টগ্রামগামি হচ্ছে রোহিঙ্গারা। তাই চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশ ও এপিবিএনের যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযান প্রতিদিনই অব্যাহত থাকবে।উখিয়াস্থ ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. আমির জাফর বলেন, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গারা বাইরে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ ক্যাম্পের কাঁটাতারের দুশো অংশে কেটে ফটক তৈরি করে বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া রোধে চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। এসব চেকপোস্টে গত মঙ্গলবার অভিযান চালিয়ে ২০০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। এরপর তাদেরকে স্ব-স্ব ক্যাম্পের ইনচার্জদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
অধিনায়ক মো. আমির জাফর আরও বলেন, কাঁটাতারের বেড়া কেটে ২’শো স্থান দিয়ে রোহিঙ্গাদের বেরিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে অবাধে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ২’শো স্থানও চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন এই স্থানগুলো দ্রুত মেরামত করা প্রয়োজন। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, যারা বিনা অনুমতিতে আশ্রয়শিবির থেকে বাইরে যাচ্ছে, তাদের বিভিন্নভাবে বোঝানো হচ্ছে। কাউন্সেলিং ও এ দেশের আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে তাদের ধারণা দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে একই রকম অপরাধে ধরা পড়লে তাদের জেল-জরিমানার ভয় দেখানো হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের ট্রানজিট ক্যাম্পের মাধ্যমে বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।