বাংলাদেশ সর্বদক্ষিণের প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের উপকূলবর্তী একটি গ্রাম ‘চামিলা’। যে গ্রামটি দেড় শতাধিক ঘর করে বসবাস করে মগ ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ। আর এই গ্রামটি এক-একটি ঘরই বন্দিশালা। গ্রাম বসবাসকারি সকলেই একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সদস্য। যেখানে বর্তমানে কয়েক শত বাংলাদেশ জিন্মি করে মুক্তিপণের টাকার জন্য চালানো হচ্ছে নির্মম নির্যাতন। যার মধ্যে গত ৩ বছর আগে থেকে বন্দি থাকা বাংলাদেশী যুবকও রয়েছে।
সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারির চক্রের কবলে পড়ে মিয়ানমারে পাচারের পর সেই বন্দিশালা নানা প্রক্রিয়ায় পুলিশের ফেরত আনা ৭ জন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
রবিবার রাতে মিয়ানমার থেকে সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা এই ৭ জনকে এনে নামিয়ে দেন টেকনাফের মিঠাপানির ছড়ার সংলগ্ন সৈকতে। যেখান থেকে পুলিশ এই ৭ জনকে উদ্ধার করে। এর আগে এ ঘটনায় পুলিশ সংঘবদ্ধ পাচারকারি চক্রের নারী সহ ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তারও করেছে। সোমবার দুপুর আড়াই টার দিকে কক্সবাজার সদর থানায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন, কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ( সদর সার্কেল) মো. মিজানুর রহমান।
গ্রেপ্তার পাচারকারি চক্রের সদস্যরা হলেন, টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুর বিল এলাকার মৃত ওমর হামজার ছেলে মো. বেলাল উদ্দিন (২৮), সাবরাং ইউনিয়নের লাফার ঘোনার এলাকার আবদুল গফুরের মেয়ে মাহফুজা (২২), একই ইউনিয়নের গোলারপাড়া এলাকার মৃত আবদুল গণির ছেলে আব্দুল্লাহ (৫৫) ও মিয়ানমারের বুচিডং এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে মো. আয়াছ (২৬)।
পাচারকারি চক্রের আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়ারা হলেন, চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের স্টেশন পাড়ার আবদুর রহমানের ছেলে রায়হান উদ্দিন (২৮), সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুরের মো. হোসেন আলীর ছেলে মো. হাবিব উল্লাহ (১৬), কক্সবাজার পৌরসভার বৈদ্যঘোনা এলাকার কফিল উদ্দিনের ছেলে মো. রায়হান কবির (১৬), একই এলাকার আবুল হাশেমের ছেলে মো. আলমগীর (১৮), মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুর ইউনিয়নের সোনা মিয়ার ছেলে সফর আলী (১৭), একই এলাকার আলী আজগরের ছেলে শওকত আজিজ (১৮) ও উখিয়ার থাইংখালী এলাকার মো. ইউনুসের ছেলে মো. মামুন মিয়া (২১)।
আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সদর থানায় লিপিবদ্ধ হওয়া ২ টি সাধারণ ডাইরীর তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারি চক্র কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, মহেশখালী, উখিয়ার কিছু কিশোর ও যুবককে নানা প্রলোভ দেখিয়ে উন্নত জীবনের কথা বলে মালেয়শিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে জিম্মি করে। তাদের প্রথমে টেকনাফের লেঙ্গুর বিল এলাকায় নিয়ে যায়। এরপর সাগর পথে মিয়ানমারের একটি আস্তানায় নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে। ওখানে জিন্মি করার পর নির্যাতন চালিয়ে ফোনে স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপনের টাকা দাবি করে।
তিনি জানান, স্বজনরা নির্যাতনের খবর পেয়ে নানাভাবে পাচারকারীদের বিভিন্ন অংকের টাকাও প্রদান করে। এই টাকা গ্রহণকারি লোকজন, তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ পাচারকারি চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর গ্রেপ্তারদের কৌশলে ব্যবহার করে রবিবার রাতে মিয়ানমার থেকে টেকনাফের সমুদ্র সৈকত এলাকায় ফেরত আনা হয় ৭ জনকে।
মিজানুর রহমান জানান, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তি ও গ্রেপ্তারের কাছ থেকে আর নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব তদন্ত করে পাচারকারি চক্রের অন্যান্য সদস্যদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও নিখোঁজ অন্যদের বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় কক্সবাজার সদর থানা ছাড়াও পৃথকভাবে উখিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী ও চকরিয়া থানায় মামলা হয়েছে।
মিয়ানমার থেকে ফেরত আনাদের কয়েকজন ও স্বজনরা যা জানিয়েছেন :
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরে-ঘুরে কয়েক বছর ধরে আনার ফল বিক্রি করে সংসারের খরচ চালান সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুরের মো. হোসেন আলীর ছেলে মো. হাবিব উল্লাহ। ৪ সেপ্টেম্বর সৈকতে এক যুবক তাকে জানিয়েছিল টেকনাফে এক-একটি আনার ফল ৫ টাকায় পাওয়া যায়। যেখানে আনার ফলের বিশাল বাগান রয়েছে। ৫ টাকায় ফল কিনে বিক্রি করে অধিক মুনাফা পাওয়া আশার টেকনাফে আনার ফল কিনতে গিয়ে ছিল হাবিব উল্লাহ। টেকনাফের লেঙ্গুর বিল এলাকার একটি ঘরে পৌঁছার পর পরই তাকে বেঁধে রাখা হয়। হাবিব উল্লাহ জানান, ওই ঘরে টানা ৬ দিন তাকে বন্দি করে রাখা হয়। এরপর রাতে হাত-পা বেঁধে তুলে দেয়া হয় একটি ট্রলারে। যে ট্রলারে তিনি সহ মোট ৩৮ জন ছিলেন। যাদের ট্রলার যোগে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মিয়ানমারের সাগরের নিকটবর্তী একটি গ্রামে। গ্রামে পৌঁছার পর পর তাদের আলাদা আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে বেঁধে রাখা ছিল। মারধর ছাড়াও হত্যার হুমকি দিয়েছিল। দাবি করা হয় বিভিন্ন অংকের টাকা।
হাবিব জানান, তাকে যে ঘরে বন্দি করা হয়েছিল ওখানে আরও ৭/৮ জন রয়েছে।
ফেরত আনাদের মধ্যে চকরিয়ার রায়হান উদ্দিন জানান, সৈকতের ব্যবসা করেন তিনি। যেখানে পান বিক্রেতা আরিফ নামের এক যুবকের সাথে তার পরিচয় রয়েছে। সেই আরিফ টেকনাফে ব্যবসা ভাল বলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। টেকনাফের পর্যটন এলাকায় পৌঁছার পর পরই অজ্ঞাত লোকজন তাকে জিন্মি করে একটি ঘরে নিয়ে যায়। যে ঘরে আরও লোকজন বেঁধে রাখা ছিল। ৬ দিন পর তাদের ট্রলারে তুলে দিয়ে ছিল। সেই থেকে মিয়ানমারের চামিলা গ্রামের একটি ঘরে বন্দি রাখা হয়েছিল। দাবি করা টাকা তার পরিবারের লোকজন বিকাশ যোগে পাঠানোর পর আবারও ট্রলার যোগে তাকে সহ ৭ জন টেকনাফে ফেরত পাঠানো হয়।
ফেরত আসার বৈদ্যঘোনা এলাকার মামুন মিয়া জানান, রাজমিন্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন তিনি। কাজের সূত্র ধরে টেকনাফে বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। যেখানে যাওয়ার পর সৈকত এলাকা থেকে অজ্ঞাত লোকজন তাকে জিন্মি করে একটি ঘরে বেঁধে রাখেন। ২ দিন পর তুলে দেয়া হয় একটি ট্রলারে। যে ট্রলারটি ছিল ৩৩ জন। সমুদ্রে একের পর এক ৪ টি ট্রলার পরিবর্তন করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চামিলা গ্রামে।
মামুন জানান, গ্রামটিতে দেড় শতাধিক ঘর রয়েছে। ওখানে কিছু পরিবার মগ, কিছু পরিবার রোহিঙ্গা। প্রতিটি ঘরে ঘরে কয়েক জন করে বাংলাদেশী যুবককে বেঁধে রাখা হয়েছে। যাদেরও একই কায়দায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যরা টাকা পাঠানোর পর তাকে রবিবার রাতে ফেরত পাঠানো হয়।
ওই সময় কক্সবাজার সদর থানা প্রাঙ্গনে ছিলেন মামুন মিয়ার মা ছেনোয়ারা বেগমও। তিনি জানান, তার সন্তান জিন্মি করার পর একমাত্র সম্পদ ইজিবাইক (টমটম) বিক্রি করে পাওয়া টাকা ও ধার করে মোট এক লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন বিকাশে। এরপরই ছেলেকে এনে নামিয়ে দেয়া হয় সাগরের কাছে।
চকরিয়ার রায়হানের পিতা আবদুর রহমান জানান, ছেলেকে জিন্মি করার পর নির্যাতন চালানো হয়। এরপর বিকাশে পাঠানো হয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এরপর পুলিশের নানা তৎপরতায় ছেলেকে ফেরত পেয়েছেন।
কক্সবাজার সদর থানার পুলিশের তথ্য মতে, নিখোঁজ ৭ জনের মধ্যে কক্সবাজার সদর থানায় রায়হান ও হাবিবের ঘটনায় সাধারণ ডাইরী হয়েছিল। সেই ডাইরীর সূত্র ধরেই একে একে ৭ জনকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। যার মধ্যে ৪ জনকে পরিবার বিকাশে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে। যেখানে রায়হানের পরিবার এক লাখ ২০ হাজার টাকা, সফর আলীর পরিবার ৭৫ হাজার টাকা, শওকতের পরিবার ৭৫ হাজার টাকা ও মামুন মিয়ার পরিবার ৭০ হাজার টাকা পাঠিয়ে বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
গ্রেপ্তারদের সম্পর্কে যে সব তথ্য জানা গেছে :
সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রলোভন সহ নানা কৌশলে মিয়ানমারে পাচার করে জিন্মি করে একটি চক্রের অন্যতম হোতা গ্রেপ্তার বেলাল উদ্দিন। উদ্ধার হওয়ারা যে ঘরটিতে জিন্মি করার কথা বলেছেন ওটা লেঙ্গুর বিল এলাকায় বেলাল নিয়ন্ত্রিত এক ঘর। যেখানে মুল মানুষকে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, বেলাল নিয়ন্ত্রিত ঘরচি গুমাদ ঘর হিসেবে পরিচিত। তার অধিনের চক্রটি মুলত মানুষজনকে জিন্মি করে, ট্রলারে তুলে দেয়। মিয়ানমারে পৌঁছার পর শুরু হয় ভিন্ন খেলা। এই ভিন্ন খেলার নেতৃত্ব দেয় বেলালের বান্ধবী মাহফুজা। মিয়ানমারের চক্রটি ফোন করে টাকা আদায়ের চেষ্টা শুরু করে। আর এসব টাকা আদায়ের জন্য ব্যবহার করা হয় আবদুল্লাহর বিকাশ এজেন্সের নম্বর সমুহ। যার কাজে সহযোগি আয়াছ। আবদুল্লাহ সাবরাং এলাকার পরিচয় দিয়েও তার বোন, মা, বাবা, ভাই মিয়ানমারের থাকেন। তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেই টেকনাফে বসে বিকাশের এজেন্সের নামে হুন্ডি ব্যবসা করে থাকে। এই আবদুল্লাহই হুন্ডির মাধ্যমে চক্রের কাছে টাকা পাঠিয়ে দেন। মিজানুর রহমান জানান, এ সংঘবদ্ধ চক্রটি বিশাল। অনেকের নাম পাওয়া গেছে। এদের ধরতে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
মিয়ানমারের চামিলা গ্রামে আরও অনেকেই বন্দি থাকার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেয়া হয়েছে। কোন থানায় কারা নিখোঁজ আছে, এসংক্রান্ত ডাইরীর তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ডাইরীর তথ্যের সাথে মিলিয়ে দেখা যাবে কতজন নিখোঁজ রয়েছে তার তথ্য।
এই অভিযানে অংশ নেন পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) এসএম শাকিল হাসান, উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আবদুল আজিজ, সাঈদ নুর।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজার সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) কাইছার হামিদ, পরিদর্শক (গোয়েন্দা) দূর্জয় বিশ্বাস।