প্রভাবশালীদের অব্যাহত দখল দৌরাত্ম্যে উজাড় হচ্ছে মধুপুরের শালবন

প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১৩:০১ | অনলাইন সংস্করণ

  টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

কয়েক দশকের অব্যাহত জবর দখল সামাজিক বনায়ন সহ নানা কারণে উজাড় হওয়ার পথে মধুপুরের শালবন। 

বনবিভাগের সূত্র মতে মধুপুর বনাঞ্চলের মোট আয়তন ৪৫ হাজার ৫৬৫ দশমিক ১৭ একর। জবর দখলকৃত বনভূমির পরিমান ১৪ হাজার ৮৮০ দশমিক ৯৬ একর। এছাড়া বনভূমির উপর পাকা রাস্তাসহ বিভিন্ন বসতি গড়ে ওঠায় গ্রামীন পথ ও হাট বাজারের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়দের সূত্রমতে জবর দখলকৃত বনভূমির পরিমান আরও অনেক বেশি। বনভূমির অনেক এলাকা জুড়ে চাষ হচ্ছে কলা, আনারস, পেঁপে, আদা, কচু, হলুদ সহ নানা জাতের ফলজ উদ্ভিদ। বর্তমানে দেখে অনুমান করা কঠিন যে কয়েক দশক আগেও এতদাঞ্চলে ছিল শাল-গজারির প্রাকৃতিক বন। এছাড়াও গহীন এ জঙ্গলে আজুকী, সিদা, কাইকা, চাপালিস, হরিতকি, বহেড়া, আম, জাম, আমলকি, হিজল, তেতুল, আমড়া সহ নানা দেশীয় প্রজাতির উদ্ভিদ। আর এসব গাছের ফল খেয়ে বন্য প্রাণীরা জীবনধারন করত। ওই সময় জীব বৈচিত্র আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য বনভূমি ছিল মধুপুর বনাঞ্চল। 

স্থানীয় প্রভাবশালীদের অব্যাহত জবর দখলের ফলে ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে এ বনাঞ্চল। টাঙ্গাইল বনবিভাগ জবর দখলকারীর সংখ্যা ১০ জনের তালিকা দিলেও প্রকৃত জবর দখলকারীর সংখ্যা চার সহ¯্রাধিক। তাদের তালিকায় সামাজিক মর্যাদাশীল ব্যক্তি বা রাজনীতিকদের নাম নেই। বনবিভাগের দাবি প্রতিবছর জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। মধুপুর বনাঞ্চল ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ২’শ একর এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের ৩৭ দশমিক শূন্য পাঁচ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত ওই ভূমিতে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে বিদেশী প্রজাতীয় চারা রোপন ও সেই সাথে আনারস, কলা সহ বিভিন্ন ফলজ গাছও লাগানো হয়েছে। সর্বোপরি এসব সামাজিক বনায়ন কতখানি অর্থবহ হবে এ নিয়ে পরিবেশবাদীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বর্তমানে টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ মহাসড়কের পচিশ মাইল থেকে রসুলপুর পর্যন্ত রাস্তার পাশে কিছু প্রাকৃতিক বাগান চোখে পড়ে। এছাড়া বনভূমির অধিকাংশ জায়গা সামাজিক বনায়নের আদলে ফসলের মাঠে পরিণত হয়েছে। বনবিভাগের সূত্র মতে বর্তমানে ৬ হাজার ৭৫৬ দশমিক ৭৪ একর প্রাকৃতিক এবং ৬ হাজার ১৭৯ দশমিক ১৫ একর সামাজিক বনভূমি বিদ্যমান রয়েছে। 

টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান জানান, গত কয়েক দশকে বনভূমি জবর দখল হলেও কয়েক বছর ধরে বনভূমি উদ্ধার কাজ অব্যাহত রয়েছে। জবর দখলকারী প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে বন মামলা না হওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, বন নিধনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে প্রত্যক্ষভাবে জবর দখলে যারা সংশ্লিষ্ট নন তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ নেই। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ জানান, বনবিভাগ জবর দখলকৃত যেসব ভূমি উদ্ধার করছে সেসব জায়গায় শাল-গজারি সহ দেশিয় প্রজাতির চারা রোপন করে প্রাকৃতিক বন গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিদেশী প্রজাতির যেসব গাছ রোপন করে সামাজিক বনায়ন তৈরি করা হচ্ছে তাতে জীব বৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকিজনক।

মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সাইন্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এম এস সাইফুল্লাহ জানান, সামাজিক বনায়ন কখনোই প্রাকৃতিক বনের পরিপূরক হতে পারে না। মধুপুর বনাঞ্চলে ক্রমাগত প্রাকৃতিক শাল-গজারির বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়ন করার ফলে জীব বৈচিত্র ও পরিবেশ ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। সামাজিক বনে আনারস, কলা ও পেঁপে চাষ করার ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। বিদেশী প্রজাতির গাছ রোপনে বন্য প্রাণী, পশু-পাখি সহ অন্যান্য জীবজন্তু মধুপুর বনাঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।