সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির জন্য দায়ী ইজিবাইক, ব্যাটারি রিকশা, টমটম ও অবৈধ থ্রি হুইলার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা, হাইওয়ের আইন মোতাবেক রাস্তার উভয় পাশের অবৈধ স্থাপনাসহ হাট-বাজার সরিয়ে নেয়া সহ সাতদফা বাস্তবায়নের দাবিতে পরিবহন ধর্মঘট ডাক দিলেও মহাসড়কসহ বিভিন্ন স্থানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সিএনজি, থ্রি- হুইলার, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা।
রবিবার সারাদেশের ন্যায় কক্সবাজারে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
অভিযোগ উঠেছে, কক্সবাজারের ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে এইসব অবৈধ যানবাহন চলাচল অব্যাহত রয়েছে। খোদ ওই সভায় কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী, জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ কর্মকর্তাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, নিদিষ্ট বাসস্ট্যান্ড থাকার পরও কক্সবাজারের কলাতলীসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক দখল করে বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের ' অঘোষিত ' বাসস্ট্যান্ড গড়ে তুলার বিষয় নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় ওই সভায়।
অনুষ্টানে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান তাঁর বক্তব্যে বলেন, কক্সবাজারে ঐতিহ্যগতভাবে রাস্তার উপর হাট বাজার বসানো হয়। বিশেষ করে গরুর বাজারগুলো দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তাই আগামী অর্থ বছর থেকে রাস্তার উপর থেকে সব বাজার সরানো হবে। এতে কমে আসবে দুর্ঘটনা।
তিনি আরও বলেন, চালকদের অদক্ষতা ও অসচেতনতার কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আগে নিজেদের সচেতন হতে হবে। মানতে হবে ট্রাফিক আইন। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রশিক্ষণ ও প্রচারণা প্রয়োজন। এছাড়া সন্তানদের বাইক কিনে দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সামনে রেলপথ চালু হলে কক্সবাজারে মানুষের ঢল নামবে। এক্ষেত্রে সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। তাই মানুষের জীবন-জীবিকার বিষয়টি মাথায় রেখে আস্তে আস্তে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে, পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে বছরের পর বছর মহাসড়ক জুড়ে এসব যানবাহন পরিচালনা করছে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র। প্রতিটি গাড়ি থেকে মাসোহারা তুলে প্রভাবশালী চক্রটি স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে ম্যানেজ করে। যেসব গাড়ি মাসোহারা দেয়না সেসব গাড়ি পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেয় প্রভাবশালী চক্রটি।
অভিযোগ রয়েছে, মহাসড়কে গাড়ি চালাতে তাদের মাসিক কিংবা দৈনিক চাঁদা দিতে হয়। সমিতির মাধ্যমে এসব টাকা যায় স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশের পকেটে। টাকা না দিলে সমিতির লোকজন গাড়ি ধরিয়ে দেয় পুলিশকে। এদিকে থ্রি হুইলার সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা, নসিমন, করিমন বন্ধ ঘোষণার পরও মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ওইসব গাড়ি। স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশের নির্লিপ্ততা এবং কার্যকর তদারকির অভাবে মহাসড়কে এসব যানবাহন বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে না বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এমন অভিযোগও উঠেছে, পুলিশকে ম্যানেজ করে ১৮ বছরের নিচে অনেক কিশোর টমটমসহ বিভিন্ন যানবাহন চালাচ্ছে।
গত ১৭ অক্টোবর রামু উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা অনুষ্টিত হয়। ওই সভায় রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) ফাহমিদা মুস্তফা ১৮ বছরের নিচে কোন ড্রাইভার পাওয়া গেলেই আটক করার ঘোষনা দেন। এটি বাস্তবায়নে মাঠে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশকে মৌখিক নির্দেশনাও দেন তিনি।
একাধিক সিএনজি চালক দাবি করেন, তাদের কাছ থেকে শ্রমিক নেতারা পুলিশের নামে মাসিক টাকা নেয়। কাগজপত্র থাকার পরও রং পার্কিং এর নামে মামলার কাগজ ধরিয়ে দেয়। মালিক বা চালককে গুনতে হয় দেড়, দুই হাজার টাকা।
অন্য একটি সূত্র বলছে, কক্সবাজার ট্রাফিক অফিস থেকে বিভিন্ন উপজেলায় শ্রমিক নেতা নামধারী কিছু লোক রাখা হয়েছে। তারা নাম্বার বিহীন সিএনজি থেকে মাসিক টাকা উত্তোলন করেন। এছাড়া কক্সবাজার শহরের ১০ টি পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন ট্রাফিক ও শ্রমিক নেতাদের নামে টাকা তুলা হয় বলে একাধিক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, 'ভাই আমাদের হাত পা বাঁধা'। গাড়ি ধরলেই রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন মহলের তদবিরে ছাড়তে হয়। এমনকি সাংবাদিকদের তদবিরও কম নয়। আমার কোন দিকে যাব?
গতকাল রবিবার বিকালে এই প্রসঙ্গে কুমিল্লা রিজিয়ন চট্রগ্রাম জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. নাসিম খানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মহাসড়কে নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার গাড়ি মোটেও চলতে পারবে না। হয়তো বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদে সাময়িক কিছু গাড়ি চলে। তিনি বলেন, প্রতিদিন হাইওয়ে পুলিশের অভিযান চলছে, আটক করে মামলাও দেওয়া হচ্ছে। আমি চট্রগ্রামে থাকি, সব তো আমার জানার কথা নয়। তবুও খোঁজ রাখব। টাকা লেনদেনের বিষয়ে সু-নিদিষ্টি অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় অভিযোগের বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, প্রায় সময় টোকেনের বিষয়টি শুনে আসছি। ওই সব টোকেনে মরিচ্যা, কোটবাজার লিখা থাকে। এই সব এলাকা ট্রাফিক বিভাগের নয়।
ট্রাফিক বিভাগ থেকে বিভিন্ন উপজেলায় নাম্বার বিহীন ( সিএনজি) গাড়ি থেকে টাকা উত্তোলন করার জন্য লোক রাখা হয়েছে, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নানা ভাবে বিষয়টি আমার কানে এসেছে। তবে কারা জড়িত, সু-নিদিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এদিকে গত ১৮ অক্টোবর এইসব দাবি নিয়ে পরিবহন ধর্মঘট করেন শ্রমিক সংগঠনগুলো। দাবি গুলো হলো- সড়ক ও উপ-সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, সড়কে শৃঙ্খলা আনা, বিআরটিএ’র অনুমোদন ব্যতীত মিনি বাস চ্যাসিসকে লোকাল গ্যারেজে করে দ্বিতল বাসে রূপান্তর করে স্লিপার কোচ নাম দিয়ে অপ্রস্থ রোডে চলাচল নিষিদ্ধ করা, বহিরাগত এসি/নন এসি বাস রুট পারমিটের শর্ত ভঙ্গ করে লোকাল রুটের যাত্রী বহনের কারণে গাড়িতে গাড়িতে অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ করা, সড়কের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির জন্য দায়ী ইজিবাইক, ব্যাটারি রিকশা, টমটম ও অবৈধ থ্রি হুইলার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা, হাইওয়ের আইন মোতাবেক রাস্তার উভয় পাশের অবৈধ স্থাপনা সহ হাট-বাজার সরিয়ে নেয়া, একইভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ট্রাফিক আইনে দ্বিগুণ জরিমানার বৈষম্য দূরীকরণ, চট্টগ্রাম বহদ্দারহাট আঞ্চলিক বাস টার্মিনাল সংস্কার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ, খোলা ট্রাকে লবণ পরিবহন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, রিকুইজিশানের মাধ্যমে ২ জেলায় রুট পারমিটধারী বাস মিনিবাস কোচ গাড়ি দেশের প্রত্যন্ত এলাকা ও উপজেলায় পাঠানোর নামে রিকুইজিশান বাণিজ্য বন্ধ, কক্সবাজার পৌর বাস টার্মিনালে ময়লা-আবর্জনার স্তুুপ অবিলম্বে পরিষ্কার করা।