ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

৯ মাসে নিহত ১৩৬

টাঙ্গাইলে সড়কে ঝরছে শিক্ষার্থীদের তাজাপ্রাণ

টাঙ্গাইলে সড়কে ঝরছে শিক্ষার্থীদের তাজাপ্রাণ

নতুন মোটরসাইকেল পেয়ে তরুণ মোহাম্মদ রনির কী উচ্ছ্বাস- নানা ছল-ছুঁতোয় এদিক -সেদিক যাচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে রেস করছে। আবার বাড়িতে এসে পরম মমতায় ধুঁয়ে-মুছে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করেছে। ১৯ বছরের টগ্বগে তরুণ মোহাম্মদ রনি। একাদশের পাঠ শেষে ইয়ার চেঞ্জ দিয়ে সবেমাত্র দ্বাদশ শ্রেণিতে ওঠেছে। এসএসসি পরীক্ষার পরই সরকারি জিবিজি কলেজে যাতায়াতে ছেলে মোটরসাইকেল চেয়েছিল। সে সময় ঘাটাইল উপজেলার মুখ্যগাঙ্গাইর গ্রামের ভ্যানচালক বাবা আবু মিয়া কিনে দিতে পারেন নি। দ্বাদশ শ্রেণিতে ওঠার পর ছেলের জেদের কাছে পরাজিত হয়ে অনিচ্ছা সত্বেও শখের মোটরসাইকেল কিনে দেন। সেই শখের মোটরসাইকেলই রনির জীবন প্রদীপ কেড়ে নিল। এ স্মৃতি স্মরণ করে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন বাবা মো. আবু মিয়া।

রোববার(২২ অক্টোবর) সকাল ১১টার দিকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়কে ঘাটাইল উপজেলার দেউলাবাড়ি নামক স্থানে দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। আহতাবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর ওইদিন বিকালে আহত রণি সহ দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়।

নিহত মোহাম্মদ রনির চাচা জিলানী জানান, ঘাটাইল উপজেলার সরকারি জিবিজি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে কলেজে যাচ্ছিলেন। বিপরীত দিক থেকে আসা অন্য মোটরসাইকেলে চালকসহ তিনজন আরোহী ছিলেন। তাদের মধ্যে চালক শহিদুর রহমানও(৩০) ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান। নিহত শহিদুর একই উপজেলার কদমতলী গ্রামের মেছের আলীর ছেলে। এ ঘটনায় আরও চার তরুণ আহত হয়েছেন।

অপরদিকে, কলেজ পড়–য়া ছেলের আবদার রাখতে বাবা বাধ্য হয়ে মোটরসাইকেল কিনে দেন। এরপর ছয় মাসও যায়নি। শখের সেই মোটরসাইকেলই দুর্ঘটনা পতিত হয়ে প্রাণ হারান সাব্বির আলম ও তার বন্ধু হামিদ। গত ৪ জুন (রোববার) টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়কে মধুপুরের মহিষমারা ইউনিয়নের হাজিবাড়ি মোড়ে পৌঁছলে তাদের মোটরসাইকেলটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে কলেজছাত্র সাব্বির ও তার বন্ধু হামিদ নিহত হয়। অপরবন্ধু সাদিক আহত হয়। সাব্বির ঘাটাইল উপজেলার টেপিকুশারিয়া গ্রামের মো. সুরুজ্জামানের ছেলে এবং ঘাটাইল উপজেলার সরকারি জিবিজি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। সাব্বিরের বন্ধু হামিদ একই উপজেলার পাশের মানিকপুর গ্রামের রমজান আলীর ছেলে এবং ছনখোলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র।

নিহত সাব্বিরের বাবা মো. সুরুজ্জামান জানান, তিনি প্রথমে মোটরসাইকেল কিনে দিতে রাজি ছিলেন না। তারপরও ছেলের আবদার রাখতে বাধ্য হয়ে মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। ছেলেরে শখ পূরণ করতে গিয়ে ছেলেকেই হারিয়েছেন।

নিহত সাব্বিরের চাচা নুরুল ইসলাম জানান, সাব্বির ছিল মা-বাবার বড় সন্তান। নিহত হামিদের ছোট এক বোন ও এক ভাই রয়েছে। ছোট ভাইটি মানসিক প্রতিবন্ধী। ওই ঘটনার শোক এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন পরিবার।

শুধু মোহাম্মদ রনি, সাব্বির আলম, হামিদ নয়- তাদের মতো টাঙ্গাইলের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শিক্ষার্থী শখের মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন।

পুলিশ জানায়, টাঙ্গাইল সদর, ঘাটাইল ও মধুপুরসহ বিভিন্ন উপজেলায় তরুণ-যুবক মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে তারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। এসব নিয়ন্ত্রণে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে।

ঘাটাইল থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রনি-সাব্বির-হামিদ ছাড়াও গত ২১ মাসে ঘাটাইল উপজেলায় অন্তত ১৫ জন তরুণ-যুবক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তারা সবাই বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়কে ঘাটাইল উপজেলার গুণগ্রামে দ্রæতগামী মোটরসাইকেলের সঙ্গে অজ্ঞাত একটি গাড়ির ধাক্কা লাগে। এতে ওই মোটরসাইকেল আরোহী সোনা মিয়া(২০), শামীম(২২) ও আলমগীর(৩০) ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তারা ঘাটাইলের একটি ওয়ার্কশপের শ্রমিক ছিলেন।

গত বছরের ১২ ডিসেম্বর একই সড়কে ঘাটাইলের বানিয়াপাড়া এলাকায় দ্রুতগামী মোটরসাইকেলের সঙ্গে ট্রাকের ধাক্কা লাগে। এতে মোটরসাইকেলের আরোহী সাকিম হাসান(১৭) ও সুমন(১৬) ঘটনাস্থলে নিহত হন। তারা দুজনেই ঘাটাইল সরকারি গণ উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর ঘাটাইলের ধলাপাড়া চেয়ারম্যানবাড়ির মোড়ে দ্রæতগামী মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে তিনজন স্কুলছাত্র ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তারা হচ্ছেন- শরীফ(১৬), আবু বক্কর(১৭) ও সাইম(১৬)। এছাড়া প্রতিনিয়ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে। যেসব দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে না- তার রেকর্ড থানা পর্যন্ত আসে না বলে পুলিশের একটি সূত্র জানায়।

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী শারমিন সুলতানা (২৪) ক্যাম্পাসে ফেরার পথে গত ১৭ মে কাগমারী এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন। গত বছরের ২৫ নভেম্বর টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. রাসেল নিহত হন।

জেলা পুলিশ জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯৩টি মামলা হয়েছে। এতে ১৩৬ জন নিহত ও ১১১ জন আহত হয়েছে। তবে জেলা পুলিশ ও নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠন সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে গত এক বছরে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কতজন শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছেন তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, জেলার অন্য উপজেলার তুলনায় ঘাটাইলে বেশি মোটরসাইকেল চললেও সেখানে ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্টের পদে কোনো কর্মকর্তা নেই। ট্রাফিক বিভাগ একজন শহর উপ-পরিদর্শক (টিএসআই) ও তিন জন ট্রাফিক কনস্টেবল দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে- যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

টাঙ্গাইলের সরকারি মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শামসুল হুদা জানান, কিশোর-তরুণ-যুবক ছেলেদের হাতে মোটরসাইকেল দেওয়ার ফলে বেপরোয়া গতির কারণে সড়ক-মহাসড়কে অনেক তাজাপ্রাণ ঝরছে।

তিনি জানান, অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। স্কুল-কলেজ পড়–য়া সন্তানদের মোটরসাইকেল ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। একই সঙ্গে প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার গুরুত্বের উপর জোর দেন তিনি।

টাঙ্গাইল জেলা নিরাপদ সড়ক চাই নামক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল ঝান্ডা চাকলাদার জানান, সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের বেশির ভাগই কিশোর-তরুণ-যুবক। রেজিস্ট্রেশন ও লাইনেন্স বিহীন গাড়ি বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে অনেক বাবা-মায়ের বুক খালি হচ্ছে। তিনি জানান, সড়ক দুর্ঘটনারোধে অভিভাবক, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

টাঙ্গাইল,শিক্ষার্থী,তাজাপ্রাণ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত