কক্সবাজার শহরের কাছাকাছি এলাকা খুরুশকুল ইউনিয়ন।ওই ইউনিয়নের ফকিরপাড়া এলাকায় একজন মানসিক ভারসাম্যহীন সন্তানকে নিয়ে বাঁশের বেড়া ও পলিথিন মোড়ানো একটি কুঁড়েঘরে বসবাস করেন বিধবা জহুরা বেগম (৭০)। প্রায় বিশ বছর আগে মারা যান তার স্বামী হাবিবুর রহমান। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন একমাত্র সন্তান আলী হোসাইন। ছেলে আলী হোসাইনের আয় নিয়ে সংসার চলতো জহুরার। হঠাৎ একমাত্র সস্তানটিও মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ভিক্ষা করে কোন মতে সংসার চলে জহুরা বেগম এর। নির্মম পরিহাস গত ২৪ অক্টোবর রাতে ঘূর্ণিঝড় হামুনের তাণ্ডবে জহুরার ঘরে গাছ পড়ে তছনছ হয়ে যায় তার ভাগ্য। বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছে জহুরার পরিবার। তান্ডব লীলার চার দিন পার হলেও খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে জহুরার পরিবার। এমনকি এখনোও পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি কোন সহযোগিতা পায়নি জহুরাসহ ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই।
শনিবার সন্ধ্যায় জহুরার প্রতিবেশি হোসেন আহমদের সাথে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি জানান, আজ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত জহুরার কেউ খোঁজ নেয়নি। তার মতে, জহুরার নয়, ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের খোঁজ নেয়নি প্রশাসন বা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার। এইদিকে হামুনের তাণ্ডবের চারদিন হলেও কক্সবাজারের ক্ষয়ক্ষতির চুড়ান্ত তালিকা আলোর মুখ দেখেনি।
শনিবার বিকাল থেকে সন্ধ্যা ৭ পর্যন্ত খুরুশকুল ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. রিয়াজ উদ্দিন মিনুর মুঠোফোনে বার বার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি। যার কারনে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
গতকাল সন্ধ্যায় খুরুশকুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম সিকদার বলেন, খুরুশকুল ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে হাজার হাজার বাড়ি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। তার নিজ জন্মস্থান ফকির পাড়ায় অনেক মানুষ বাড়ি ঘর হারিয়ে। বর্তমানে তারা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।
তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় হামুনের তাণ্ডবের পর থেকে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ক্ষয়ক্ষতির বিষয় অবগত করা হলে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন বলে জানান আওয়ামীলীগ নেতা দিদার।
তিনি আরো বলেন, তাঁর এলাকায় এখনো অনেকেই খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে আসছে।
খুরুশকুল ৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও মাছ ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দিন খোকন জানান, তার এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই পর্যন্ত প্রশাসন, জনপ্রতিনিধির কোন লোকজন এলাকায় আসেনি। তার ওয়ার্ডের মেম্বার মো. গিয়াস উদ্দিনের কয়েকজন প্রতিনিধি ক্ষতিগ্রস্তদের আইডি সংগ্রহ করতে দেখেছি। তবে তার আইডি কার্ডটি নেয়নি বলে দাবি করেন খোকন।
শনিবার বিকালে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ জাকারিয়ার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শুধু জহুরা নয়, অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারের তালিকা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এইদিকে কক্সবাজারের মহেশখালী হোয়ানক এলাকার বাসিন্দা শাহেদ মিজান গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় জানিয়েছেন, পুরো মহেশখালী এখনো অন্ধকারে। তিনি বলেন, দ্বীপ উপজেলার অধিকাংশ মানুষ পানের বরজের উপর নির্ভরশীল। ঘূর্ণিঝড় হামুনের তাণ্ডবে পানের বরজের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পানচাষীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন। বিদ্যুৎ সমস্যার বিষয়টি জানার জন্য মহেশখালী পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. আল আমিনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
শনিবার দুপুরে কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. কবির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পুরো জেলার ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় কক্সবাজার পৌরসভার সমিতিপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সেক্রেটারী মোস্তফা সরওয়ার জানান, পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডে পাঁচশতাধিক ঘর-বাড়ি, হাজার গাছপালা ভেঙ্গে যায়। পাশাপাশি নাজিরারটেক শুটকী মহালে কোটি টাকার শুটকী মাছ এবং ফিসপিড নষ্ট হয়ে যায়। বেশ কিছু বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে গিয়ে এলাকার অনেক মহল্লা এখনও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। অকেই খোলা আকাশের নিচে রাত খাটাচ্ছে অনেকেই। তিনি দাবি করেন, এখনো চোখে পড়ার মত ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি সাধারণ মানুষের কাছে। তিনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান বিভিন্ন এনজিও সংস্থা এবং ভিত্তশালীদের।
গতকাল সন্ধ্যা ৭ টায় কক্সবাজারের ত্রাণ ও পুর্ণবাসন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। যার কারনে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় হামুনের আঘাতে জেলার ৭০টি ইউনিয়ন, কক্সবাজার ও মহেশখালী পৌরসভার ৩৭ হাজার ৮৫৪ বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ হাজার ১০৫টি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২ হাজার ৭৪৯টি বাড়ি-ঘর। এতে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫৪৯ জন মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।