চাঁদপুরে কলেজছাত্রী অপহরণ, প্রতারনার জালে ফেলে লাখ-লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় বিমানের শুল্ক কর্মকর্তা শহিদুল

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:২৪ | অনলাইন সংস্করণ

কলেজ পড়ুয়া তরুণীর সঙ্গে বহুরুপী নব্য প্রতারক শহিদুল ইসলামের পরিচয় হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ফেক আইডির মাধ্যমে। সে বিশেষ কৌশলে বিভিন্ন সময়ে প্রতারনার জালে ফেলে লাখ-লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কলেজ পড়ুয়া তরুণীর পরিবারসহ কয়েকজনের কাছ থেকে।

চুমকি (ছদ্মনাম) তখন সবেমাত্র কলেজ পড়ুয়া তরুণী উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছেন। তারা দু’বোন একসাথে কলেজে আসা-যাওয়া করতেন। রিয়াদুল ইসলাম নামে আইডি দিয়ে শুরু হয় প্রেম। গোপনে চুমকির সাথে শহিদুলের প্রেম চলতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যে চুমকি পরিবারের লোকদের মধ্যে এই সম্পর্ক জানাজানি হয়। এই সুযোগে শহীদুল (রিয়াদুল) ইসলাম তার আসল ফাঁদ পাতেন। তার প্রতারণার সকল কৌশল অবলম্বন করে চুমকি পরিবারের কাছ থেকে ব্যাংক ও বিকাশের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন সাড়ে ১৪ লাখ টাকা। যখন তার আসল পরিচয় জানাগেল এবং নানা প্রশ্নের সম্মুখিন হলেন, তখনই সে চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে চুমকিকে অপহরণ করে নিয়ে যান। সর্বশেষ তার পদবি জানান তিনি বিমান বন্দরের একজন শুল্ক কর্মকর্তা। 

খোঁজ নিয়ে, প্রতারণার ফাঁদে পড়া পরিবার ও ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, শহীদুল ইসলাম একজন প্রতারক প্রকৃতির যুবক। তার চেহারা দেখলে মনে হবে না তিনি কোন ধরণের প্রতারণা করতে পারেন। যথেষ্ঠ অভিনয় ও বিনয়ের সাথে কথা বলে সম্পর্ক শুরু করেন। কিন্তু সর্বশেষ তার আসল রূপ ফুটে উঠে, যখন ভুক্তভোগীর নিকট তার সকল প্রতারণা ফাঁস হয়ে যায়। তখন তিনি চরম অকথ্য ভাষায় গাল মন্দ করেন এবং মান হানিকর কথা বার্তা বলে হমকি-ধমকি শুরু করে দেন। 

চুমকির পরিবারের মধ্যে অভিভাবকের ভূমিকায় তার মা। দীর্ঘ দুই বছরের অধিক সময়ে তার মায়ের সাথে প্রতারক শহীদুল ভাল সম্পর্ক তৈরী করেন। পরিচয়ের শুরুতে বলেন সে অষ্ট্রেলিয়াতে থাকেন। পিএসডি করছেন। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া কাগজ পত্র পাঠান হোয়াটসঅ্যাপে। বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জন করেন। এরপর তার বিভিন্ন সময় পড়ার খরচ, মায়ের অসুখ ও নানা সমস্যার কথা বলে চুমকির মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতে শুরু করেন। ২০২১ সাল থেকে শুরু করে ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত শহীদুল হাতিয়ে নেন প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টাকা। 

চুমকির বাড়ী চাঁদপুরের একটি উপজেলা সদরে। মান সম্মান এবং পরিবারের অন্য সদস্যের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। তবে চুমকিকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর বাকি প্রতরণার কথা জানালেন তার মা ও ভুক্তভোগীরা।

চুমকির মা জানান, শহীদুল পেশাগত পদবির সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কাগজ তৈরী করে আমাদেরকে দিয়েছে। কিন্তু তার আসল পরিচয় গোপন রেখেছে। প্রতারক চক্রের সদস্য দিয়ে ভুয়া অভিভাবক সাজায়। আমার মেয়েকে অপহরণ করার পর তার একটি জন্মসনদের কপি উদ্ধার করে আসল পরিচয় মিলে। শহীদুল ইসলাম চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার গরিবারঝিল গ্রামের মৃত নুরুল হকের ছেলে। ঢাকার দক্ষিণ খান এলাকার কলেজ রোডে প্রথম স্ত্রী প্রিয়ার সাথে থাকতেন। চুমকিকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর তার ঠিকানা আমাদেরকে দেয়নি। তবে মাঝে মাঝে অপরিচিত নম্বর দিয়ে আমাদেরকে মেসেজ দিতেন। আমাদের মোবাইল নম্বরগুলো ব্লক করে রেখেছেন। আমার মেয়ের বড় ধরণের কোন ক্ষতি করে কিনা সেই দুশ্চিন্তায় সব সময় থাকি।

তিনি জানান, মেয়েকে অপহরণের পর শহিদুল আমার মেয়ের আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে। আমাদের কাছ থেকে আবারও টাকা দাবী করে। এরপর মান সম্মানের ভয়ে আমার এক ভাইকে দিয়ে তাদেরকে কৌশলে চাঁদপুরে এনে একটি রেষ্টুরেন্টে কয়েকজন আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে এবং মুসলমান হিসেবে গত জুলাই মাসে বিয়ে দেয়া হয়। এরপর তারা প্রতারক চক্রের লোকজনসহ মেয়েকে নিয়ে ঢাকা চলে যায়। কারণ বিয়ে দেয়ার দু’দিন আগে তার প্রথম স্ত্রী প্রিয়ার পরিচয় মিলে এবং তার সাথে আমাদের কথা হয়। 

তিনি আরো জানান, ঢাকায় গিয়ে শহিদুল আবারও প্রতারণা শুরু করে। এবার সে তার ফেসবুক আইডি বাদ দিয়ে আমার মেয়ে চুমকির ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে প্রতারণা শুরু করেন। চুমকির কলেজের সহপাঠী, আমার বোনের মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ের জামাতার কাছ থেকে টাকা নেয়ার ফাঁদ পাতে। প্রতারণা করে টাকা নেয়ার যে বিকাশ ও ইউনিয়ন ব্যাংকের একাউন্ট সবগুলোর ঠিকানা ও নম্বর মিল পাওয়া যায়। এসব ঘটনা বাড়তে থাকায় কোন উপায় না পেয়ে আমি নিজে বাদী হয়ে চাঁদপুর আদালতে শহীদুল, তার স্ত্রী প্রিয়া ইসলাম ও চক্রের এক সদস্যকে আসামী করে দুটি পৃথক মামলা করি।

ফাহাদ নামে চুমকির এক কলেজ সহপাঠী কাজ করেন ঢাকায়। চুমকির আইডি থেকে ফেসবুক পোস্ট দিয়ে মুল্যবান আইফোন বিক্রির পোস্ট করেন। দাম কম হওয়ায় ওই ফাঁদে পড়েন ফাহাদ। কম দামে আইফোন পাওয়া যাবে বলে মেসেঞ্জারে কথা বলে একাধিক কিস্তিতে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দেন ফাহাদ। এরপর থেকে ফাহাদের সাথে শহিদুলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। রিয়াদ জানান, শহীদুলের ফাঁদে পড়ে আমি এখন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

ফাঁদে পড়া চুমকির খালাত বোন সুইটি জানান, চুমকির বিয়ে হয়েছে জানি। কিন্তু প্রতারকের সাথে হয়েছে এটি জানতাম না। আমার খালার পরিবার স্বচ্ছল। যে কারণে কোন সন্দেহ না করে গত ২৩ অক্টোবর চুমকির মেসেঞ্জার থেকে নক দিলে কথা বলি। এরপর শহীদুল ও চুমকি আমাকে সোনার বার দিবে বলে প্রস্তাব দেয়। সুইটির কাছে সোনার বারের মূল্য হিসেবে প্রথমে বড় অংকের টাকার কথা বললেও পরে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা নেন বিকাশ, নগদ ও ইউনিয়ন ব্যাংকের একাউন্টে। এই ঘটনায় আমি আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। 

সুইটি আরো জানান, সোনার বারগুলো আমাকে চাঁদপুরে পৌঁছাবেন বলে শহরের হাজী মহসীন রোডে দাঁড় করিয়ে রাখেন এবং এরপর ঢাকায় পর্যন্ত আমাকে নিয়ে ছাড়েন প্রতারক শহিদুল। এরপর থেকে আমার মোবাইল নম্বর বøক করে দেয় সে। এখন আমাদের সকল নিকটাত্মীয়দেরকে জানানো হয় প্রতারকের কথা।

চাঁদপুর থেকে সোনার বারের বকেয়া টাকা উঠানোর জন্য চুমকির মামাত বোনের জামাতা সোহাগের সাথে যোগাযোগ করেন শহিদুল। কিন্তু তার প্রতারণার কৌশল বুঝতে পেরে সোহাগের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন কয়েকদিনের মধ্যে।

চাঁদপুর আদালতে শহীদুলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার আইনজীবী চৌধুরী ইয়াছিন ইকরাম জানান, বাদীর দেয়া কাগজপত্র দেখে আমাদের মনে হয়েছে শহীদুল ইসলাম নামে বিবাদী বিভিন্ন ধরণের প্রতারণামূলক কাজ ও সরকারি দপ্তরের কাগজপত্র নকল করেছেন এবং বাদীর মেয়েকে অপহরণ করেছেন। যে কারণে তার বিরুদ্ধে একাধিক ধারায় পৃথক দুটি মামলা হয়। মামলাগুলো পিবিআইতে তদন্তের জন্য রয়েছে।

অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চাঁদপুর কার্যালয়ের উপ-পরিদর্শক (এসআই) রিয়াদ হাসান এবং প্রতারণা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শরীফ উল্যাহ। কর্মকর্তারা জানান, শহীদুল যেভাবে বাদীর সাথে প্রতারণা করেছেন এবং আর্থিক লেনদেন করেছেন সেসব কাগজপত্র আমরা পেয়েছি। তদন্ত কার্যক্রম চলছে। নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।

এসব বিষয়ে বক্তব্যের জন্য অভিযুক্ত শহিদুল ইসলামের ব্যাক্তিগত একাধিক মোবাইল নম্বরে ফোন করে তাকে পাওয়া যায়নি। যে কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।