রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনের ঘটনায় ট্রেনের যাত্রী নেত্রকোণার নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার শিশুপুত্র ইয়াসিন আরাফাত (৩) মারা গেছেন। পপি সদর উপজেলার দক্ষিণ বিশিউড়া ইউনিয়নের বরুনা গ্রামের আব্দুল মজিদের পুত্রবধূ ও মিজানুর রহমানের স্ত্রী।
মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোরের দিকে এই নাশকতামূলক ঘটনার শিকার হন তারা। মা-ছেলের একসাথে মৃত্যূর ঘটনায় তাদের গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
জানা যায়, দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে ট্রেনটির চারটি বগি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বগির ভিতরে থাকা যাত্রীদের মধ্যে চারজন জ্বলে-পুড়ে নিহত হন। তাদের দুইজন এই নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার শিশুপুত্র ইয়াসিন আরাফাত। গ্রামের বাড়িতে এই খবর আসার পর পরই স্বজনরা বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাদের আহাজারি গ্রাম ছেড়ে দূর-দুরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ভারী হয়ে উঠে এলাকার আকাশ-বাতাস। বিভিন্ন এলাকার লোকজন তাদের বাড়ি এসে ভীড় করেন।
পপির পারিবারিক সূত্র ও স্থানীয়রা জানান, মিজানুর রহমান ঢাকার কাওরান বাজারে হার্ডওয়ারের (পার্সের) ব্যবসা করেন। তিনি স্ত্রী নাদিরা আক্তার পপি ও দুই সন্তান ফাহিম ও ইয়াসিন আরাফাতকে নিয়ে কাওরান বাজারে বাসা ভাড়া করে থাকেন। গত ১১ ডিসেম্বর পপি সন্তানদের নিয়ে বরুনা গ্রামে তার স্বামীর বাড়িতে বেড়াতে আসেন। গত রোববার নেত্রকোনা জেলা শহরের কুরপাড়ে ভাশুর আবদুল কাদিরের বাসায় মিলাদ ছিল। সন্তানদের নিয়ে ভাশুরের বাসায় যান পপি আক্তার। বেড়ানো শেষে গত সোমবার রাত ১২টার দিকে মোহনগঞ্জ এক্্রপ্রেসে করে ভাই হাবিুবর রহমান ও দুই শিশু-সন্তানকে নিয়ে ঢাকার বাসায় ফিরছিলেন তিনি। তা আর হল না। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে আদরের সন্তানসহ মরতে হল তাকে।
জানা যায়, মঙ্গলবার ভোরের দিকে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন ধরিয়ে দেয় দৃর্বৃত্তরা। এ সময় পপি তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিনকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন। আগুনে পপি ও ইয়াসিন আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। এ সময় পপির ভাই হাবিবুর রহমান ভাগ্নে ফাহিমকে নিয়ে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে রক্ষা পান। মঙ্গলবার সকালে এ দুর্ঘটনার খবর নেত্রকোনার বরুনা গ্রামে পৌঁছায়। খবর পেয়ে এই প্রতিনিধি মঙ্গলবার বিকেল দুইটার দিকে বরুনা গ্রামের আব্দুল মজিদের বাড়িতে যান। এ সময় দেখা যায় যে, নিহত পপি ও তার শিশুপুত্রের মর্মান্তিক ঘটনায় বাবা ফজলুল হক, শাশুরী মেহের বানু, শশুর আবদুল মজিদসহ অন্যান্য স্বজনরা শোকে মাতম করছেন। এ সময় পর্যন্ত প্রশাসনের কেউ এখানে আসেন নাই বলে জানা যায়।
শহর বানু কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলছিলেন- “কি দোষ করছিল আমার বৌমা ও ছোট্টা নাতী। কেন তারা আগুনের শিকার অইল। দাদা ভাই যাওনের সময় আমারে কইছিল- দাদু যাই। আবার আইবামনে। বৌমা কইছিল- মা শরীরের খেয়াল রাইখেন। আর কোন দিন তাদের ফিরে পাইতাম না। আমি তারারে আর দেখতে পারতাম না। অআমি এই ঘটনার বিচার চাই”।
পপির বাবা নেত্রকোনার পূর্বধলার আলমপুর গ্রামের ফজলুল হক খবর শুনে জামাইয়ের বাড়িতে যান। মেয়ে ও নাতিনের অকাল মৃত্যূতে তিনিও আহাজারি করছিলেন। তিনি বলেন, আমি কি অপরাধ করছিলাম। কি দোষে আমার নিস্পাপ নাতী ও মেয়েকে আগুনে পুড়ে মরতে অইল।
জানা গেছে, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে সোমবার রাত ১১টায় ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশন এসে থামলে তখন কিছু যাত্রী সেখান থেকে নেমে যায়। এসময় তাদের পেছনের ছিটে থাকা দুই ব্যক্তিও নেমে যায়। এরপর পিছনের ছিট থেকে আগুন জ্বলে উঠে। মুহূর্তেই আগুন পুরো বগিতে ছড়িয়ে পড়ে।
নেত্রকোনা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ঢাকায় ট্রেনে আগুনে পুড়ে কয়েকজন যাত্রী মারা যাওয়ার কথা শুনেছি। এ ব্যাপারে থানায় কেউ কিছু জানায়নি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নেত্রকোনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া তাবাসসুম বলেন, মরদেহ এখনও গ্রামের বাড়িতে পৌছায়নি। নিহতদের পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।