ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নব্য কোটিপতি মৃনাল কাণ্ড

এক শতক জমি নিয়ে অস্বস্তিতে ঈদগাঁও'র সনাতনী সম্প্রদায়, দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা

প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ কামনা
এক শতক জমি নিয়ে অস্বস্তিতে ঈদগাঁও'র সনাতনী সম্প্রদায়, দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা

কক্সবাজারের প্রাচীন বাণিজ্যিক এলাকা ঈদগাঁও বাজার। ১৯৬২ সালে বাজার এলাকায় এক শতক জমি কিনেছিলেন ইসলামাবাদ হিন্দুপাড়ার মৃত নন্দ কুমার দের ছেলে যতিন্দ্র মোহন দে। আর.এস ১৩৬ ও এম.আর.আর ১৫৬ খতিয়ানের ৬৯৩৬ দাগের সেই জমিটি দুটি রেজিস্ট্রি দলিলে বুঝে নিয়ে তাতে তিনটি দোকানঘর তুলেন। এর ভাড়া দিয়ে পরিবার চালাতেন যতিন্দ্র। তিনি মারা যাবার পর জমিটির স্বত্বদার হন তার চারসন্তান মৃদুল কান্তি দে, দয়াল কান্তি দে, রূপন কান্তি দে ও অজিত কান্তি দে। এরা চার ভাইয়ের একজন রিকশা চালান, দু'ভাই শ্রমিক, অপরজন শারিরীক প্রতিবন্ধি। বিএস জরিপে জমিটি খাস খতিয়ানভুক্ত হলে যতিন্দ্রের সন্তানরা বিএস সংশোধনে মামলা করেন (অপর-২২৭/১২ ও অপর-২৭০/২৩) যা এখনো চলমান।

বাবার সময়ে তিন দোকানে তিনজন ভাড়াটিয়া ছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালে অন্য দুজনকে বের করে নতুন অবকাঠামোই দুটি দোকান এক করে ভাড়া নেন একই ইউনিয়নের হরিপুর এলাকার মৃত অর্ধেন্দু আচার্য্যের ছেলে স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃনাল আচার্য্য। যতিন্দ্রের চার সন্তান দোকান ঘরের ভাড়া সমান ভাগে নিতেন। ভাড়াটিয়া হিসেবে নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করে এলেও ২০২১ সালে নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতির পদ পেয়ে দোকানের ভাড়া দেয়া বন্ধ করেন মৃনাল। ভাড়ার চাইলে দরিদ্র চারভাইকে তাড়িয়ে দিয়ে জমিটি তার দাবি করা শুরু করেন ভাড়াটিয়া মৃনাল। হঠাৎ জমির মালিকানা দাবির বিষয়ে, মৃনাল তাদের জানান- খাস খতিয়ানের এজমি ২০১৭-২০১৮ সনে তিনি লীজ নিয়েছেন।

এমনটি হয়ে থাকলে ২০২০ সালেও ভাড়া পরিশোধ করেছিলেন কেন? আর জমির বিএস সংশোধনী মামলা চলছে ২০১২ সাল হতে- মামলাধীন জমি কিভাবে লীজ হয়? ভাড়া না দিলে দোকান ছাড়ুন- এমনটি বলার পর তাদের (যতিন্দ্রের ছেলেদের) বিরুদ্ধে ঈদগাঁও থানায় চাঁদাদাবির অভিযোগ দেন মৃনাল।

ইত্যবসরে, দোকানের মালিকরা গোপন লীজের বিষয়টি জেনে জেলা প্রশাসক ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) বরাবর লীজ বাতিলের আবেদন করেন।

উভয় পক্ষকে ডাকা হয় থানায়। এতে জমির মালিক চারভাইয়ের সাথে হিন্দু সমাজের নেতা এবং ভাড়া চুক্তির সাক্ষি হিসেবে ঈদগাঁও কেন্দ্রীয় কালী মন্দিরের সভাপতি উত্তম রায় পুলক, বাজারের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী পরিমল দে, সাবেক মেম্বার বাবুল কান্তি দে'সহ নেতৃত্বস্থানীয়রাও যান। সেখানে মৃনাল চুক্তির বিষয় এবং অতীতের সকল কর্মকান্ড অস্বীকার করে নেতৃবৃন্দকে 'দালাল' আখ্যা দিয়ে অশালীন আচরণ করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে, ক্ষোভে ফুঁসে উঠেন সাধারণ সনাতনী সমাজ। এ নিয়ে বৃহত্তর ঈদগাঁওর একাধিক হিন্দুপাড়ার নেতৃবৃন্দ বৈঠক করেন। এতে মৃনালের দখল ও অপকর্ম খোলাসা হয়। বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে অসহায় পরিবারের দোকান গৃহের ভাড়া পরিশোধ ও লীজ বাতিলে অনুরোধ করা হলে মৃনাল অসম্মতি জানিয়ে উল্টো সবাইকে গালমন্দ ও হুমকি দেয়।

এসব বিষয় জানার পর, ঈদগাঁওর সাধারণ সনাতনী নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে গত ১১ ডিসেম্বর (সোমবার) মৃনালের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও ঝাঁড়ু মিছিল করেন। মিছিল নিয়ে নারী-পুরুষ দোকানে যাচ্ছে দেখে পালিয়ে বাঁচেন মৃনাল। এ ঘটনার দুদিন পর মৃনাল আচার্য্য ব্যক্তিগত ইস্যুতে পূজা উদযাপন পরিষদের ব্যানারে ভাড়াটিয়া লোকজন নিয়ে নিজের মতো করে বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিলে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে দালাল আখ্যা দিয়ে, আপত্তিকর স্লোগান দেয়া হয়। এখানে নিজে ও পরিবারের লোকজন থাকলেও পূজা উদযাপন পরিষদের কোন নেতৃবৃন্দ ছিলেন না। রাখা হয় স্থানীয় বেশ কিছু মুসলমান যুবকদেরও।

ঝাঁড়ু মিছিল এবং মৃনালের বিক্ষোভ মিছিলের ছবি ও ভিডিও এবং স্লোগান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। নব্য কোটিপতি মৃনালের লোভ চরিতার্থ করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আদিস্থান ঈদগাঁওতে মৃনালের পক্ষে কতিপয় মুসলিম যুবককে ব্যবহার করায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির উপক্রম হয়েছে।

ভোক্তভোগী মৃদুল কান্তি দে, ফিলিপ কান্তি দে, দয়াল কান্তি দে বলেন, একসময়ের হত-দরিদ্র মৃণাল আচার্য্য স্বল্প সময়ে কোটিপতি। চুরি-ডাকাতির স্বর্ণ নামমাত্র দামে ক্রয়, স্বর্ণে ভেজাল মিশানো ও ভূমিদস্যুতা ও সরকারি জমি দখল করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তাদের দিয়ে বাজারের স্বর্ণপট্টিতে পাবলিক টয়লেট ও খাসজমিতে তুলেছেন বহুতল ভবন। পূঁজা উদযাপন পরিষদ সভাপতির পদ পাওয়ার পর দখল ও অবৈধ কর্মকান্ড বেড়েছে বহুগুণ। সর্বশেষ ভাড়াটিয়া হিসেবে থেকে স্বর্ণপট্টির আমাদের দোকান ঘর ও জমি দখলে নিতে মরিয়া হয়েছেন তিনি।

ঈদগাঁও উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ আহবায়ক ও জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক চন্ডি আচার্য্য বলেন, পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি হিসেবে মৃনাল আচার্য্য উপজেলার সকল সনাতনীদের অভিভাবক। ওনার বিরুদ্ধে অন্যের জমি দখলের অভিযোগ উঠা মানে রক্ষক-ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সামিল। ঈদগাঁওর চলমান বিষয়টি নিয়ে আমরা সনাতনী সমাজ খুবই বিব্রত। সকল হিন্দু নিরাপদ থাকুক এটাই আমাদের কাম্য।

ইসলামাবাদ ইউনিয়ন পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সুমন কান্তি দে বলেন, ভাড়াটিয়া হয়ে মালিকের জমি নিজ নামে লীজ নেয়া মোটেও সমীচীন হয়নি। বিষয়টা সমাধানের চেয়ে ছড়াতে গোপনে অপতৎপরতা চালাচ্ছে বেশ কয়েকটি গ্রুপ। এ ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের মানহানির চেষ্টা ও হুমকির বিষয় সবাইকে শংকিত করছে। এটার সুষ্ট সমাধান দরকার।

সালিশকারক ও এলাকার সাবেক মেম্বার বাবুল কান্তি দে জানান, হঠাৎ বিত্তবান হয়ে পরের জমি-দোকান দখল মৃনাল আচার্য্যের নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোপুর্বেও স্বর্ণপট্টিতেই প্রতিবেশী কমলেন্দু আচার্য্যের দোকান দখল নিতে নিজের যুবতী মেয়েকে ধর্ষিতা সাজিয়ে মামলা করেছিলেন। যা পরে মিথ্যে প্রমাণিত হয়। মৃত মাকে চাদর মুড়ি দিয়ে রেখে পাশের আরেকজনের জমি দখল নিতে গিয়ে ধিক্কারের শিকার হন মৃনাল। এখন প্রতিবন্ধি পরিবারের জমিও একই ভাবে দখলে নিতে হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে ভাড়ায় কতিপয় মুসলিম যুবকদের ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা করছেন তিনি। যা সাধারণ হিন্দুদের মাঝে ভীতি সঞ্চার করেছে। ঈদগাঁও কেন্দ্রীয় কালী মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও হোটেল পুবানির স্বত্বাধিকারী উত্তম রায় পুলক বলেন, মৃণাল আচার্য্যের হাতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বারবার নির্যাতিত হয়ে আসছে। তার বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ে অনেক বিচার-সালিশ হলেও সিদ্ধান্ত মানেননি তিনি। উল্টো আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছে। আমি ঈদগাঁও থানায় জিডিও করেছি। তার ছোটভাই অশোক আচার্য্য আইনজীবী ও ভাতিজা মিঠুন আচার্য্য জেলা জজশীপে চাকরিরত। এ দুজনকে ব্যবহার করে আইন-আদালত নিজেদের পক্ষে ব্যবহারে অপচেষ্টা চালান। সাম্প্রতিক ঘটনায় প্রতিবন্ধি পরিবারের সদস্য, তার অপকর্মের প্রতিবাদকারিদের নাম উল্লেখ করে আদালতে মামলা করতে যান মৃনাল। যা সরাসরি খারিজ করে দেন আদালত।

ব্যক্তিগত দ্বন্ধে পূঁজা উদযাপন পরিষদের ব্যানার ব্যবহারের বিষয়ে ঈদগাঁও উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সাধারণ সম্পাদক জিকু দাশ সুব্রত বলেন, চলমান ঘটনাগুলো মৃনাল আচার্য্যের নিতান্তই ব্যক্তিগত ও জমি দখল সংক্রান্ত। এখানে সংগঠনের ব্যানার ব্যবহার মুটেও সমীচীন হয়নি। কোন কাজে সংগঠন ব্যবহার করতে হলে জেলা নেতৃবৃন্দের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট শাখার সিদ্ধান্ত লাগে। মৃনাল আচার্য্যের মিছিলে পরিষদের ব্যানার ব্যবহারে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত ছিল না। মিলিছে পূঁজা পরিষদের কেউ না এলেও ভিন্নধর্মালম্বীদের সামিল করা হয়েছে। সেখানে যে স্লোগান দেয়া হয়েছে তা সনাতনী সম্প্রদায়ের জন্য মানহানিকর।

অভিযুক্ত মৃণাল আচার্য্য বলেন, জমির মালিকানা বিচারিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। এখানে অনেক 'রাঘববোয়াল' কলকাঠি নাড়ছেন। আমি অন্যায় করি না। সংগঠনের কাজ না হলেও, আমার ভক্তরা ব্যানারে পূজা পরিষদের নাম ব্যবহার করেছে- এতে সাংবাদিকের চোখে ভুল ধরা পড়া অযৌক্তিক। আমাকে পছন্দ করা মুসলিম ভাইয়েরা আমার বিক্ষোভ মিছিলে এসেছে- ঘাপটি মারা বর্ণচোরাদের নিয়ে স্লোগান দিয়েছে; এতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবার কি আছে?

বক্তব্যের শেষে সাংবাদিকরা ওনার বক্তব্য বিকৃত করছেন বলেও উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মৃনাল।

ঈদগাঁও থানার ওসি শুভ রঞ্জন চাকমা বলেন, আমি নতুন যোগ দিয়েছি- আশার পর মৃনাল-মৃদুলদের বিষয়টি জেনেছি। স্বার্থগত দ্বন্দ্বে তারা একে অপরের পক্ষে লোকসমাগম ঘটিয়েছে। জমির সিদ্ধান্ত আদালতের বিষয়। এরপরও বিষয়টি নিয়ে যেন অপ্রীতিকর কোন কিছু না ঘটে সেটা নিশ্চিত করতে উভয়পক্ষকে থানায় ডাকা হবে।

কক্সবাজার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত