ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কক্সবাজারে পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগের ভুতুড়ে বিলে দিশেহারা গ্রাহক

কক্সবাজারে পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগের ভুতুড়ে বিলে দিশেহারা গ্রাহক

কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার পূর্ব মুক্তারকুল ভাঙ্গাব্রিজ এলাকার ওয়ার্কশপ দোকানি গিয়াস উদ্দিন। দোকানটি করে কোনোমতে সংসার চলে তাঁর। এ দোকানে সর্বসাকুল্যে লক্ষাধিক টাকারও মালপত্রসহ পুঁজি নেই। গিয়াসের এই দোকানে মাসে ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল আসে।

চলতি বছরের জুলাই মাসে সেই দোকানে বিদ্যুৎ বিল আসে ২ লাখ ৮২৭ টাকা। ভুতুড়ে বিলের কাগজ হাতে পেয়ে দরিদ্র ওয়ার্কশপ দোকানি গিয়াস হতবাক ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। এমন ভুতুড়ে বিল নিয়ে পল্লী বিদ্যুতের তখনকার দায়ীত্বে থাকা জেনারেল ম্যানেজার বরাবর তিনি লিখিত অভিযোগ করলে সেটি সংশোধন করে ৬২ হাজার ৭৪৮ টাকার আরেকটি নতুন বিল তৈরি করে দেন। সেই টাকা পরিশোধ করে সেবার কোন রকম নিস্তার পান তিনি। পরে আগস্ট মাসে পুনরায় নির্ধারিত সময়ে টাকা না দিলে বিলম্ব মাশুলসহ (সুদ) দুই লাখ ৩৩ হাজার টাকার একটি বিল দেয় পল্লী বিদ্যুৎ।

নিরুপায় হয়ে এই বিষয়টি নিয়ে তিনি পুনরায় লিখিত অভিযোগ করেন গিয়াস। ঘুরেন কর্তাবাবুদের দ্বারে দ্বারে। সেটির সমাধান না করে উল্টো পরের মাসে আরও দুটি বিল দেয় কতৃপক্ষ।

বিষয়টি নিয়ে গন্যমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে ক্ষেপে যায় কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুতের কর্তাবাবুরা। উল্টো বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর বিদ্যুতের সংযোগটি বিছিন্ন করে দেন তাঁরা। সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করা করার পর গিয়াসের একমাত্র আয়ের উৎসটি বন্ধ হওয়ায় দুঃশ্চিন্তায় তার দু’চোখে অমানিশার ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। এবাবেই পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা-কর্মচারীরা পুরো ৪৮ হাজার গ্রাহককে জিম্মি করে রাখেছেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

অভিযোগ রয়েছে, কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নতুন জেনারেল ম্যানেজার গোলাম আহম্মদ যোগদানের পর থেকে সবচেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন সেখানকার কর্মচারি-কর্মকর্তারা। গ্রাহক হয়রানিতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গেই চলছেন তাঁরা।

কখনো ৪-৫ গুণ বেশি বিল ভুতুড়ে বিলের কাগজ ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার সেই বিল নিয়ে মুখ খুললেই সেই গ্রাহণের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। পুনঃসংযোগ পেতেও গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এসব বিষয়ে অভিযোগ দিয়েও গ্রাহকরা সময়মতো প্রতিকার পাচ্ছেন না। কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সদর দপ্তর অফিসে কোনো বিষয়ে জানতে গেলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তোপের মুখে পড়তে হয় গ্রাহকদের। তাদের অসৌজন্যমূলক আচরণ ও হুমকিতে গ্রাহকরা নিরুপায় হয়ে পড়েছেন। এভাবেই এক প্রকার জিম্মি করে রেখেছেন ৪৮ হাজার গ্রহকদের।

ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, ভুল করে নয়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েই বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল করেছে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুত সমিতি। এর অন্যতম লক্ষ্য বাড়তি রাজস্ব দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস নেওয়া। তাদের এমন কারসাজিতে ভুতুড়ে বিলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অনেকে।

ভুক্তভোগী গিয়াস উদ্দিন বলেন, বিগত দিনে ৪০ থেকে ৫০ হাজার করে মাসিক বিদ্যুৎ বিল আসে। যা নিয়মিত পরিশোধ করে আসছি। হঠাৎ এক লাফে সেই টাকার অংঙ্ক চলে গেলো দুই লাখের উপরে। কেন এতো বিল হল জানতে এ বিষয় কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুত অফিসে গেলে ক্ষিপ্ত হয়ে যান সেখানকার কর্মকর্তারা। এই বিষয়টি স্থানীয়ভাবে জানাজানি হলে পল্লী বিদ্যুতের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন গনমাধ্যে সংবাদ প্রকাশ হয়। একারণে তাঁরা যুক্তিসংগত কারণ না দেখিয়ে উল্টো চড়াও হয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে আমার সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এখন আমার ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে।

ঝিলংজার পর্ব মুক্তারকুল এলাকার দিনমজুর ফরিদুল আলম বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার বিল প্রতিমাসে পরিশোধ করে আসছি। কিন্তু এই মাসের একটি বিলে বকেয়া মাস দাবি করে ৩০০ টাকার বেশি যোগ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিমাসে বিল পরিশোধ করার পরও এই ৩০০ টাকা কিসের জানতে চাইলে সেটি ২০২০ সালের টাকা বলে দাবি করছে তারা। অথচ আমার কোনো বকেয়া নেই।

জানা গেছে, কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সদর দপ্তরের আওতায় রয়েছে প্রায় ৪৮ হাজার গ্রাহক। প্রতি মাসে এসব গ্রাহকের ব্যবহৃত বিদ্যুতের বিল লিখে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুৎ ব্যবহারের শুরুর পর থেকে বিগত বছর থেকে বিল বাড়ানো হচ্ছে। কেউ কেউ কয়েক বছর থেকে ভুতুড়ে বিলের বোঝা টেনে বেড়াচ্ছেন। ভুতুড়ে এমন বিল সংশোধন করতে গেলে নেসকোর কর্মকর্তা, কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন গ্রাহকরা। কেউ কেউ টেবিলের পর টেবিল ঘুরেও মিলছে না ভুতুড়ে বিলের সমাধান।

কায়সার ও সোহেল নামের দুজন গ্রাহক জানান, বিদ্যুৎ ব্যবহারের পর থেকেই প্রতি মাসে সহনীয় বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে আসছি। কিন্তু হঠাৎ প্রতিটি মাসে ২-৩ গুণ বেশি বিদ্যুৎ বিল আসে। সংশোধনের জন্য বিদ্যুৎ অফিসে গেলেও কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারে ২য় বার সংশোধন করাতে মন চায় না। তা ছাড়া বিল সংশোধনের জন্য চাপ দিলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করারও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে বাধ্য হয়েই ভুতুড়ে বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে।

কবির ও মনছুর নামে দুই গ্রাহক জানান, করোনা মহামারি শুরুর দিকে প্রতি মাসে ৬০০-৭০০ টাকা বিল এসেছিল। দুটি ফ্যান, একটি টেলিভিশন ও চারটি লাইট জ্বালিয়ে এখন বিল আসছে ১৪০০ থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত।

আকলিমা নামের একজন জানান, তিনি বাসায় একা থাকেন এবং একটি লাইট ও একটি ফ্যান ছাড়া কিছুই চালান না। এরপরও গত এক বছরে তার প্রতি মাসে প্রায় ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা ভুতুড়ে বিল দিয়ে যান এবং বাধ্য হয়ে তাকে এ বিল পরিশোধ করতে হয়।

মহিউদ্দিন নামের এক গ্রাহক জানান, আগে মাসে আবাসিকে তার বিদ্যুৎ বিল আসতো সাড়ে ৪০০ টাকা। কিন্তু কয়েকমাস ধরে বিল করা হয়েছে ১ হাজার টাকার উপরে। মিটারের রিডিংয়ের সঙ্গে পল্লী বিদ্যুতের বিলের রিডিংয়ের কোনো মিল নেই। বিল সমন্বয় করতে পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ে গেলে কর্মকর্তা-কর্মকর্মচারীরা বিষয়টি সমন্বয় না করে অশোভন আচরণে বাগিবতণ্ডা করেন। এছাড়া পার্শ্ববর্তী ঘরের মিটার ব্যবহার করা না হলেও সেখানে ২০ ইউনিট ধরে বিল করা হয়েছে।

সবুজ নামের একজন জানান, চলতি মাসে তার ২ হাজার টাকার বেশি বিদ্যুৎ বিল করা হয়েছে। দুই দিন পল্লীবিদ্যুৎ অফিসে গেলেও বিল সমন্বয় করা হয়নি। কর্মকর্তারা প্রথমে বিল পরিশোধ করতে বলেন, সমন্বয়ের বিষয়টি তারা পরে দেখবেন বলে জানান।

এলাকাবাসীরা জানান, পল্লী বিদ্যুতের বিলের এই ধরনের সমস্যা নতুন নয়। এ ছাড়া অনেক মানুষ রয়েছে, যারা পড়াশোনা জানেন না, মিটারের রিডিং বোঝেন না। তাঁরা পল্লী বিদ্যুতের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিদ্যুৎ বিল প্রদানের ক্ষেত্রে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের আরও সচেতন থাকার অনুরোধ জানান তাঁরা।

জনশ্রুতি রয়েছে, ভুল করে নয়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েই বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল করেছে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুত সমিতি। এর অন্যতম লক্ষ্য বাড়তি রাজস্ব দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস নেওয়া। এছাড়া সদরের বিভিন্ন এলাকায় অটোরিকশা ও চার্জার রিকশার গ্যারেজ রয়েছে প্রায় শতাধিকের মতো। কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ওইসব গ্যারেজে মাসিক চুক্তির বিনিময়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছেন। সেখানে পর্যাপ্ত ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকের ঘাড়ে। এ নিয়ে কর্মকর্তা ব্যক্তিদের অভিযোগ দিয়েও সুফল না পাওয়ায় একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছেন এই কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সদর দপ্তরের প্রায় সব বিদ্যুৎ গ্রাহক।

এ বিষয়ে কথা বলতে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী গোলাম আহম্মদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। এরআগে তিনি প্রতিবেদকে দাম্ভিকতার সাথে এইসব অভিযোগের ব্যাপারে গ্রাহকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।

কক্সবাজার,পল্লী বিদ্যুৎ,ভুতুড়ে
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত