আস্তানায় বিস্ফোরক, বোমা তৈরির সরঞ্জাম : গ্রেপ্তার ৩
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার নাশকতার ছক
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯:১০ | অনলাইন সংস্করণ
স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার
কক্সবাজার শহরের পর্যটন জোন কলাতলী এলাকায় মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠি ‘আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা) এর একটি আস্তানার সন্ধান পেয়েছে র্যাব ১৫। যে আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ ককটেল, বিস্ফোরক সদৃশ বস্তু, সামরিক বাহিনীর ন্যায় পোশাক এবং বিভিন্ন রকম বোমা তৈরীর সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরসা’র লজিস্টিক শাখার প্রধান হাফেজ রহমত উল্লাহ সহ তিন সন্ত্রাসীকে।
র্যাব জানিয়েছে, বোমা ও মাইন তৈরীর সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে মজুদ করতে এই আস্তানটি ব্যবহার করতো। যা উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা’র সদস্যদের কাছে নাশকতার জন্য পাঠানো হত। মুলত আরসা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাশকতা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে। ইতিমধ্যে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ’র একটি অডিও বার্তাও র্যাবের হাতে এসেছে। যেখানে ক্যাম্পে নাশকতা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপর হামলার নিদের্শ দিয়েছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠিটির প্রধান।
রবিবার দুপুরে র্যাব ১৫ এর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র্যাব ১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এএইচ সাজ্জাদ হোসেন।
তিনি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের রবিবার সকাল ৯ টায় কক্সবাজার শহরের কলাতলী আদর্শগ্রামের ডিসি পাহাড় সংলগ্ন একটি ভঅড়া বাড়িতে এই অভিযান চালানো হয়।
অভিযানে গ্রেপ্তাররা হলেন, উখিয়ার ৩ নম্বর ক্যাম্পের মৃত আবুল কাশেমের ছেলে এবং আরসার লজিস্টিক শাখার প্রধান হাফেজ রহমত উল্লাহ (৩৫), ৫ নম্বর ক্যাম্পের মো. নুরুল ইসলামের ছেলে এবং আরসার একটি উপদলের নেতা মঞ্জুর আলম (২৩), একই ক্যাম্পের কামাল হোসেনের ছেলে এবং আরসার ব্লক জিন্মাদার নুরুল ইসলাম (২৫)।
অভিযানে উদ্ধার হয়েছে, ৪.৯ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, ১৫ টি ককটেল, আইডি তৈরীর সরঞ্জাম, ১.৫ কেজি মারকারী, ১টি ওয়াকিটকি, ৫৩টি সার্কিট, ৯ বান্ডিল সামরিক বাহিনীর ন্যায় পোষাক তৈরীর কাপড়, ৭০টি গেঞ্জি, ১২টি টুপি, ১৩০টি হ্যান্ড গ্লোভস, ১টি ল্যাপটপ।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব ১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এএইচ সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা রহমদ উল্লাহ ২০০০ সালে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর শাহপরীরদ্বীপে অবস্থান করে। যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন মেয়াদে হাফেজ, দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়াশুনা করে এবং বার্মিজ, রোহিঙ্গা, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবী ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠে।
পড়াশুনা শেষে সে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার চলে যায়। মিয়ানমার থেকে নিজ জমি-জমা বিক্রি করে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া চলে যায়। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে চলে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস শুরু করে। ২০১৯ সালে আরসার গান গ্রæপ কমান্ডার মাষ্টার ইউনুছের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মৌলভী রফিকের মাধ্যমে হাফেজ রহমত উল্লাহ আরসায় যোগদান করে। আরসায় যোগদানের পরপরই তাকে মিয়ানমারে ট্রেনিং এ পাঠানো হয় এবং সেখানে ৪ মাস অবস্থান করে আরসার হয়ে ট্রেনিং সম্পন্ন করে। রহমত উল্লাহ আরসায় যোগদান করার পর প্রথমে আরসার ওলামা বডির সদস্য হয় এবং বিভিন্ন মসজিদে সাধারণ রোহিঙ্গাদের আরসায় যোগদানের দাওয়াত প্রদান করতো। এছাড়াও সে আরসার ওলামা বডির সদস্যদের দাওয়াতি ট্রেনিং প্রদান করতো। এর মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ওসস্তাদ খালেদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সিগনাল এপ্স এর মাধ্যমে হাফেজ রহমত উল্লাহ তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রাখতো। আরসার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট, বোমা ও মাইন বানানোর জন্য বিভিন্ন মালামাল সংগ্রহ এবং সরবরাহ করার সুবিধার্থে ওস্তাদ খালেদের নির্দেশে কক্সবাজার শহরে ভাড়ায় বাসা নিয়ে বসবাস শুরু করে। এ সুবাদে সে আরসার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট, বোমা ও মাইন বানানোর জন্য বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ করার দায়িত্ব পায় এবং লজিষ্টিক শাখার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
র্যাব অধিনায়ক জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রহমত উল্লাহ জানায় সে আরসা প্রধান এবং সামরিক শাখার প্রধানের ডিমান্ড অনুয়ায়ী বিভিন্ন উৎস হতে লজিষ্টিক সরঞ্জামাদি বিশেষ করে আরসার জন্য ইউনিফরম এর কাপড়, শীত বস্ত্র, রেইন কোট, বুট জুতা, মোজা, বেল্ট, ক্যাপ, ব্যাগ এবং বোমা ও মাইন বানানোর জন্য হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মারকারী (পারদ), ফোম, টর্চ লাইট, ব্যাটারী, ব্যাটারীর ক্যাপ, ইলেকট্রিক তার, ইলেকট্রিক ক্লিপ, ছোট টেবিল ঘড়ি, ছোট লাইট, লোহার রড, সিমেন্ট, ছোট লোহা, পাইপ, কাচঁ সহকারে নানান ধরনের বোমা ও মাইন তৈরীর সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করতো এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে তা জমা রাখতো। পরবর্তীতে আরসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড খালেদের নির্দেশনা অনুয়ায়ী সরঞ্জামাদি উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা’র সদস্যদের কাছে প্রেরণ করতো।
এএইচ সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, মঞ্জুর আলম ৫ নম্বর ক্যাম্পের বি ব্লকের আরসার জিম্মাদার হিসেবে কাজ করে এবং সে ১০ জনের দলনেতা। নুরুল ইসলাম একই ক্যাম্পের বি/৪ ব্লকের জিন্মাদার। নুরুল ইসলাম এবং মঞ্জুর আলম সরঞ্জামাদি রহমত উল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে যেত। এব্যাপারে মামলা করে ৩ জনকে কক্সবাজার সদর থানায় সোপর্দ করা হয়েছে বলে জানান।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, র্যাব-১৫ এক বছরে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আরসা’র শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সামরিক কমান্ডার, গান গ্রুপ কমান্ডার, অর্থ সম্পাদক, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ’র একান্ত সহকারী ও অর্থ সমন্বয়ক মোস্ট ওয়ান্টেড কিলার গ্রুপের প্রধান, ক্যাম্প কমান্ডার, ওলামা বডি ও টর্চার সেল এর প্রধান, স্লীপার সেল ও ওলামা বডির অন্যতম শীর্ষ কমান্ডার, অর্থ সমন্বয়ক, ইন্টেলিজেন্স সেলের কমান্ডারসহ সর্বমোট ৮৩ জন আরসা’র সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। এ অভিযান অব্যাহত রাখা হবে।