রংপুরে  সিনেমা হলের নাম আছে অস্তিত্ব নেই

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:০২ | অনলাইন সংস্করণ

  রংপুর ব্যুরো

রংপুরে  সিনেমা হলের নাম আছে অস্তিত্ব নেই । এক সময় ১২টি সিনেমা হল চালু থাকলে ও এখন চালু মাত্র ২টি সিনেমা হল । টাউন হল ছাড়াও এক যুগ আগেও রংপুরে অন্তত ১২টি সিনেমা হল সচল ছিল। ওই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের দাপট আর সিনেমা হলগুলোর জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি ছিল ব্যাপক। বর্তমানে বেশিরভাগ হলের অস্তিত্ব না থাকলেও এখনো ‘লক্ষী হলের মোড়’, ‘ওরিয়েন্টাল মোড়’ ‘দরদী হলেল মোড়’ ‘নুরমহল (আকাশ) মোড়’ ‘বিডিআর হল মোড়’ ‘সেনা অডিটরিয়াম মোড়’ ও ‘শাপলা হল’ ‘চায়না হল’ ও ‘মিতালী হল’সহ বিভিন্ন হলের নামডাক বা খ্যাতি রংপুরে রয়েছে।

কিন্তু গত কয়েক বছরের সিনেমা হল ব্যবসায় অকল্পনীয় ধ্বস আর অশ্লীলতায় ভরা নিম্নমানের নকল চলচ্চিত্র নির্মাণে মুখ থুবড়ে পড়েছে সিনেমা হল। দর্শকরাও হয়েছে হল বিমুখ। যে কারণে হল মালিকরা ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। সিমেনা হলগুলোতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে তালা। জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকতে থাকতে রংপুরের বেশির ভাগ সিনেমা হলই এখন শুধুই ইতিহাস। সচলের খাতায় এখন শুধুমাত্র শাপলা টকিজ ও আকেশ টকিজের নাম। বাকি সব বন্ধ হয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অশ্লীলতায় ভরা নিম্নমানের ও নকল ছবি নির্মাণ সিনেমা হল থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে দর্শকদের। তাছাড়া সিনেমা হলগুলোর পরিবেশ বর্তমানে ভদ্রলোকের অনুকূলে নয়। বর্ধিত সিটি কর্পোরেশন এলাকাসহ রংপুর জেলার মধ্যে বর্তমানে শুধুমাত্র শাপলা টকিজ ও আকাশ টকিজে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এ দুটি সিনেমা হলের অধিকাংশ দর্শকই সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর। সঙ্গে রয়েছে নোংরা বিনোদনে অগ্রহী উঠতি বয়সের বখাটে যুবক ও যুবতীদের হিড়িক। তবে মাঝে মধ্যে এই হলে ভালো মানের দেশীয় বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রও প্রদর্শিত হয়। তখন অবশ্য সিনেমা পিপাসু সব বয়সী দর্শকের উপচে পড়া ভীড় চোখে পড়ে।

খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে ১৯৭৮ সালে গড়ে ওঠা থাকা শাপলা টকিজ। এই হলটির মূল মালিক নজরুল ইসলাম মাসুমের মৃত্যুর পর তার ভাই মিন্টু মিয়া হলের দায়িত্ব নেন। কিন্তু হলের ব্যবসা ভালো না হওয়ায় শাপলা টকিজ ভাড়া দিয়ে দেয় কামাল হোসেন নামে এক চলচ্চিত্র প্রযোজকের কাছে। সেই শাপলা টকিজের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন শাহাবুদ্দিন নামে হল ব্যবস্থাপক। তিনি ব্যবসার মন্দাভাবে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আশা ছিল জেলার উন্নতমানের শাপলা সিনেমা হল ভালো চলবে। কিন্তু এর অবস্থা আরো খারাপ। এভাবে লোকসান হতে থাকলে হলটি চালানো আর সম্ভব হবে না।’
শাহাবুদ্দিন জানান, বর্তমানে তার শাপলা টকিজে যে আয় হচ্ছে তা দিয়ে সিনেমা হল মালিকের ভাড়া দেওয়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ ও  কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু চলচ্চিত্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখতেই শাপলা হল ভাড়া নিয়ে ভর্তুকি দিচ্ছেন মালিক। তবে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু চলচ্চিত্রকে ঘিরে ভালো ব্যবসা হয়েছে এবং এখনও সেই রেশ রয়েছে।

আকাশ টকিজের জেনারেল ম্যানেজার রকিবুল আজাদ বলেন, করোনাকালীন প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল। তিন মাস আগে চালু হয়েছে। খুব একটা ভালো চলছে না। সরকারের অনুদান দেওয়ার কথা ছিল, সেটা এখনো আমরা পাইনি। অর্থাভাবে ঠিক মতো সংস্কার হচ্ছে না। এখন সিনেমা হলের বসার সিট, সাউন্ড সিস্টেম ও ডেকোরেশন খুব ভালো অবস্থায় নেই।

এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, চায়না টকিজ, নুর মহল ও দরদী সিনেমা হল এখন গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সেনা অডিটোরিয়াম বন্ধ করে দিয়ে সেখানে আর্মি মেডিক্যাল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট গড়ে তোলাসহ ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মী সিনেমা হলের যন্ত্রপাতি অনেক আগেই লোপাট হয়ে গেছে। অবকাঠামোও প্রায় ধ্বংসের পথে। ওরিয়েন্টাল সিনেমা হলে ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। দরদী হলটি ভেঙে সেখানে করা হয়েছে দোকানপাট।
দর্শকদের অভিযোগ, ঘুরেফিরে একই ধরনের নিম্নমানের সস্তা ও কুরুচিপূর্ণ নকল ছবি নির্মাণ সিনেমা হল থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে দর্শকদের। তাছাড়া সিনেমা হলগুলোর পরিবেশ বর্তমানে ভদ্রলোকের অনুকূলে নয়। সিনেমা হলের দর্শক এখন সমাজের খেটে খাওয়া মানুষজন। সঙ্গে রয়েছে নোংরা বিনোদনে আগ্রহী উঠতি বয়সের বখাটে যুবকদের হিড়িক।

নগরীর শাপলা চত্বর এলাকায় ব্যবসা করেন তসলিম মিয়া। যার বয়স এখন ৭০ বছরের কাছাকাছি। সেই তসলিম মিয়া সত্তরের দশকের স্মৃতিচারণ করে বলেন, রংপুরে আগে টাউন হল ও ওরিয়েন্টাল হল ছিলো। আর সিনেমার টিকিট তখন ছিল মহার্ঘ। টিকিট কাটতে গিয়ে কতবার মারামারিতে জড়িয়েছি। হাত কেটে গেছে, পরনের কাপড় ছিঁড়ে গেছে। তবুও প্রিয় নায়ক-নায়িকা রাজ্জাক, শাবানা, ববিতা, আলমগীর, ফারুক বা খান আতার ছবি না দেখে বাড়ি ফিরিনি। তাছাড়া তখনকার ছবিগুলো ছিল সামাজিক ও বাস্তবধর্মী।

শাপলা টকিজে প্রিয়তমা সিনেমা দেখতে আসা দর্শকদের একজন নন্দ কিশোর। তার সাথে কথা হলে সিনেমানুরাগী এই তরুণ জানান, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এখন ঘরে বসেই টেলিভিশনের পর্দায় নয়তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুবন বিখ্যাত কত সিনেমা দেখা যায়। এখন তো আগের মতো দর্শকের প্রত্যাশার সিনেমা তৈরি হয় না। বরং সিনেমার নামে বাংলাদেশে যা তৈরি হচ্ছে, তা রীতিমতো বিরক্তিকর। তারপরও বড় পর্দায় সিনেমা দেখার অনুভূতিটা অন্যরকম। অনেকদিন পর সিনেমা হলে এসেছি, যদি প্রিয়তমা ভালো লাগে, তাহলে হলে ফিরে আসাটা সার্থক মনে হবে।
সিনেমা হল ও দেশীয় চলচ্চিত্র রক্ষায় সরকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের যত্মবান হওয়া দরকার বলে মনে করেন রংপুর বিভাগীয় লেখক পরিষদের সভাপতি ও সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব কাজী জুননুন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, একসময় নতুন কোন সিনেমা আসছে তা জানার জন্য দর্শকদের মাঝে ব্যাকুলতা ছিল। পাশাপাশি গ্রাম থেকে কোনো কাজে শহরে এলে মানুষ সিনেমা দেখে যাওয়ার তাড়না বোধ করত। এখন সেই দিন নেই। আগের মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুখী সিনেমাও নেই।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। সুস্থ চিন্তা-চেতনায় মানুষকে শাণিত করতে চলচ্চিত্র শিল্পকে রক্ষা করা দরকার। ফলে এ কাজে সরকার ও চলচ্চিত্র নির্মাণকারী উভয়কে যতœবান হতে হবে। আর এ দুটি বিষয় সমন্বিত হলে আমাদের চলচ্চিত্রের হারানো গৌরব ফিরে না এলেও মানুষ সিনেমা হলমুখী হবে বলে আমি মনে করি।