কক্সবাজারে ৫শতাধিক স্পটে নির্বিচারে পাহাড় কাটার উৎসব
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:২৮ | অনলাইন সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
কক্সবাজারজুড়েই প্রায় ৫ শতাধিক স্পটে নির্বিচারে পাহাড় কাটার উৎসব চলছে। বনকর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে পুরোদমে চলছে পাহাড় নিধনযজ্ঞ। নির্বিচারে পাহাড় কেটে সাবাড় করে ফেলছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুচক্র। এ কাজে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। পরিবেশ বিধ্বংসী এ পাহাড় কাটা রোধে চোখে পড়ার মতো প্রশাসনিক কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে দ্বিগুণ উৎসাহে কক্সবাজার জেলাজুড়েই শত শত পাহাড় দিনে-দুপুরে কেটে সাবাড় করা হচ্ছে।
গতকাল শনিবার ভোরে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের ইনানী রেঞ্জের জালিয়াপালং বনবিট এলাকায় ডাম্পারে মাটি কাটতে গিয়ে মুসলিম উদ্দিন(২০) নামের এক শ্রমিকের নিহত। নিহত মুসলেম উদ্দিন উখিয়ার জালিয়া পালং ১ নম্বর ওয়ার্ড পাইন্যাশিয়া চাককাটার নুরুল ইসলামের ছেলে।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে ওসি বলেন, শনিবার ভোরে মুসলেম উদ্দিন নামের এক শ্রমিক স্থানীয় হেলাল কোম্পানীর ডাম্পার ট্রাকে মাটি কাটতে গেলে হঠাৎ করে বড় একটি মাটির চাক ও গাছের ধারালো শিকড় ভিকটিমের গোপন অঙ্গের অণ্ডকোষের পাশে ডুকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে গুরুতর আহত হয়, সাথে থাকা অন্যান্য শ্রমিকরা ভিকটিম কে উদ্ধার করে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরবর্তী খবর পেয়ে থানা থেকে পুলিশের একটি টিম লাশ উদ্ধার করে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এবং আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে ওসি জানান।
অভিযোগ উঠেছে, ইনানী রেঞ্জের জালিয়াপালং, রাজাপালং বিটের তুুতুরবিল, রেজুরকুল, ঘোনারপাড়া, কবিরের টেক, ঘোনারপাড়া, বাঘঘোনা,পাইন্যাশিয়া, রেজুরকুল, জুম্মাপাড়া, সোনাইছড়ি এলাকায় নির্বিচারে পাহাড় কাটার উৎসব চলছে। স্থানীয় রেঞ্জ কর্মকর্তা, বিট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে
তুতুরবিল রাবার ড্রাম এলাকার সরোয়ার আলমের নেতৃত্বে ৫-৬ জনের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে বালি ও মাটি বাণিজ্য করে আসছে। এই সিন্ডেকটের অন্য সদস্যরা হলেন তুতুরবিল এলাকার কামাল উদ্দিন, শাহ আলম, সালাহ উদ্দিন ও জহির।স্থানীয়রা পাহাড় কর্তনের বিষয়ে অভিযোগ করলেও কার্যকর কিছু হয় না। জালিয়াপালং বিট কর্মকর্তা মো. সোহেল হোসেন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন। শনিবার ভোরে সংঘঠিত ঘটনাস্থল এলাকা বনবিভাগের জমি নয়, বলে দাবি করেন তিনি।
ইনানী রেঞ্জ কর্মকর্তা ফিরোজ আল আমিন জানিয়েছেন, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কেটে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার অভিযানও চালানো হয়েছে। গেল রাতেও গভীর রাতে পাহাড় কাটার খবর পেয়ে অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানের খবর আগেভাগে জানতে পেরে সংঘবদ্ধ দলটি পালিয়ে যায়। তিনি চলে যাওয়ার পর আবারও পাহাড় কাটতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে। এ পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে যারা জড়িত, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী, ইসলামপুর, বাঁচামিয়ার ঘোনা, ইসুলু ঘোনা, বৈদ্যঘোনা, খাজা মঞ্জিল এলাকা, বাদশা ঘোনা, ফাতের ঘোনা, ঘোনার পাড়া, লাইট হাউস পাড়া, কলাতলী, বাইপাস সড়কের দুই পাশ, নতুন জেলা কারাগার সংলগ্ন এলাকা, নতুন পুলিশ লাইন সংলগ্ন এলাকা, লারপাড়া, উত্তরণ এলাকা, হাজী পাড়া, সদর উপজেলার পেছনে, সাহিত্যিকা পল্লী, বিজিবি ক্যাম্পের পেছনে, পল্লান পাড়া, সমিতি বাজার, দক্ষিণ রুমালিয়ার ছড়াসহ পুরো শহরজুড়েই চলছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব এলাকায় পাহাড়ের পর পাহাড় কেটে বসত বাড়ি নির্মাণ ও অসংখ্য রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠছে। অথচ প্রশাসন সব দেখেও না দেখার ভান করছে। টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কানজরপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া,হরিখোলা,দৈংগ্যাকাটা, মিনাবাজার, নয়াপাড়া, খারাংখালি, হ্নীলার দমদমিয়া, মৌচনী, লেদা, নাইটংপাড়া,বাহারছড়া ইউনিয়নে শীলখালী, মারিশবনিয়া, জাহাজপুড়া। একইভাবে উখিয়া উপজেলার পাইন্যাশিয়া, ফলিয়াপাড়া, ইনানী, পাটুয়ারটেক, নিদানিয়া, সোনারপাড়া, চোয়াংখালী, মোহামদ শফির বিল, মনখালী, থাইংখালী, বাঘঘোনা, পালংখালী, মুহুরীপাড়া, ভালুকিয়া, হলদিয়া, হাতিরঘোনা, লম্বাশিয়া, লম্বাঘোনা, মধুরছাড়া, মাছকারিয়া, ওয়ালাপালংসহ পাঁচটি ইউনিয়নের শতাধিক স্পটে পাহাড় কাটা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কাটার উৎসব চলছে।
এছাড়া রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ির চাইল্লাতলী এলাকায় পাহাড় কাটার এ ঘটনা চলছে। এলাকাটি কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের পানেরছড়া রেঞ্জের পানেরছড়া বন বিটের আওতাধীন।
সরেজমিন দেখা গেছে, রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির চাইল্লাতলী স্টেশনে রাস্তার পাশে মজুদ করা হয় পাহাড়ি বালি। পূর্ব পাশের বারিয়াপাড়া এলাকার ৪ টি পয়েন্ট থেকে পাহাড় কেটে ডাম্প ট্রাক যোগে রাত থেকে ভোর রাত পর্যন্ত চলে পাহাড়ি বালি পরিবহন। স্টেশনে মজুদ করা বালি সারাদিন ডাম্প ট্রাক যোগে বিক্রি করা হয় কক্সবাজার শহরসহ বিভিন্ন স্থানে। বারিয়াপাড়ার মুফিজুর রহমান, আবদুল মান্নান, শাহাবুদ্দিন ও আবদুল মঈনের দখলীয় পাহাড় থেকে ডাম্প ট্রাক যোগে মাটি নিয়ে পাচার করা হয়। স্থানীয় রফিকুল ইসলাম জানান, চাইল্লাতলীর বারিয়াপাড়ার ৪টি পয়েন্টে থেকে পাহাড় কেটে বালি বিক্রি করেন চাইল্লাতলী বারিয়াপাড়া এলাকার মৃত আমীর আলীর পুত্র শাহাবুদ্দিন (৩০), মৃত মোহাম্মদ কালু প্রকাশ কালু ফকিরের পুত্র ফিরোজ ও মফিজুর রহমান, মৃত মছন আলী প্রকাশ মছন ফকিরের পুত্র আবদুল মান্নান, মৃত শওকত আলীর পুত্র জসিম উদ্দিন প্রকাশ সোনা মিয়া এবং মৃত মেহের আলীর পুত্র আবদুল মঈন। এর মধ্যে শাহাবুদ্দিন ও জসিম উদ্দিনের রয়েছে ২ টি ডাম্প ট্রাক। উক্ত ডাম্প ট্রাক দুটি নিয়ে নির্বিচারে পাহাড় কেটে পাচার করা হচ্ছে বালি ও মাটি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহাবুদ্দিন পাহাড় কাটায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।
জানতে চাইলে পানেরছড়া বন বিট কর্মকর্তা মো.জলিলুর রহমান বলেন, আমি যোগদানের পর থেকে শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে ২ টি মামলা দিয়েছি, এরপরও তাঁর পাহাড় কাটা থামানো যাচ্ছে না। তবে আমরা টহল জোরদার রেখেছি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পানেরছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা রতন লাল মহত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শাহাবুদ্দিনের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি নিজেই শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছি, তাঁর গাড়িও জব্দ করেছি। পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে পাহাড় কাটা হচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কাটা বন্ধ আছে। কয়েকদিন আগেও আমি সেখানে গিয়েছি, কিন্তু পাহাড় কাটা দেখা যায়নি। প্রয়োজনে আবারও যাওয়া হবে।
সূত্র মতে, রাতের আধারে প্রভাবশালী মহল শ্রমিক দিয়ে পাহাড় কেটে সমতল করে। পরে দিনের বেলায় ঘর-বাড়ি নির্মাণ করা হয়। পাহাড় কাটা রোধে প্রশাসনের কোনো তদারকি না থাকায় জেলাজুড়ে এ কৌশল অবলম্বন করে পাহাড় কাটার মহোৎসব চলছে। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এক সময় পাহাড় কেটে মাটি মজুত করে রাখা হতো। পরে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির সঙ্গে মাটি ভাসিয়ে দেয়া হয়। এতে শহরের নিচু এলাকার সড়ক ও নালা ভরাট হয়ে পড়ে। এছাড়াও নিচু এলাকার লোকজন বিভিন্ন ক্ষয় ক্ষতিসহ নানা দুর্ভোগের শিকার হয়। তবে এখন আর বর্ষাকালে নয়, সারাবছরজুড়েই পাহাড় কাটা হয় জেলাজুড়ে।
পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপল-এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, কক্সবাজারে এখন বাধাহীনভাবে নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। কক্সবাজারে ৫০০-এর অধিক স্থানে বর্তমানে পাহাড় কাটা চলছে। এছাড়া অর্ধসহস্রাধিক ডাম্প ট্রাক নিয়ে প্রকাশ্যে নির্বিচারে চলছে পাহাড় নিধন। পাহাড় কাটার এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখলে মনে হবে, এসব বন্ধে কোন প্রশাসন নেই। কক্সবাজারের পাহাড় কাটা বন্ধে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে যৌথ অভিযান চালানোর দাবি জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা সারওয়ার আলম শনিবার ভোরে জালিয়াপালং এলাকায় পাহাড় কর্তনকালে একজন নিহতের সত্যাতা নিশ্চিত করে বলেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কাটছে বলে খবর আসছে। এরই মধ্যে জড়িতদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।