রংপুর অঞ্চলে শীত মৌসুমে রেকর্ড সবজির চাষ

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯:৩০ | অনলাইন সংস্করণ

রংপুর :রংপুর অঞ্চলে ৫জেলায় শীত মৌসুমে রেকর্ড পরিমান সব্জির চাষ হযেছে । অনুকূল আবহাওয়া ও আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় চলতি বছর সবজি চাষে ভালো ফলন পাচ্ছে কৃষকরা। ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে অনেকেরই। স্বল্প মেয়াদী শাক-সবজি আবাদ কৃষকদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করবে কিন্তু  সবজির দাম দ্বিগুণ থাকায় , সাধারণ মানুষ দিশেহারা পড়েছে।

অতিরিক্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের মধ্যে রংপুর , লালমরিহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম জেলা এলাকাভূক্ত । এ সব জেলাকে চলতি বছর প্রচুর পরিমানে সব্জি চাষ হয়েছে । এ বছর  অনুকূল আবহাওয়া থাকায়  শীতকালকে সবজির মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। অথচ মৌসুমেও শীতকালীন বিভিন্ন সবজির দ্বিগুণ দামে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। গত বছর এই শীত মৌসুমে সবজির দাম একেবারেই নাগালের মধ্যেই ছিল। এবারে উৎপাদনে খরচ বেশি ও সিন্ডিকেট এই দুই কারণে সবজির দাম চড়া বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে চড়া দামে সবজি বিক্রি হলেও রংপুরের সবজি উৎপানকারী কৃষকরা ‘পাইকার’ নামের সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।

রংপুরে উৎপাদিত সবজি প্রতিদিন ট্রাকযোগে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার প্রধান কাঁচামালের আড়ত কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। এই সুযোগেই নানা অজুহাতসহ পাইকারদের কারসাজিতে শাকসবজি চাষ করেও আশানুরুপ দাম না পাওয়ায় ঠকছেন কৃষকরা। সরাসরি মহাজনদের কাছে দরদাম করে সবজি বিক্রি করার সুযোগ নেই কৃষকের। শুধুমাত্র হাত বদল করেই লাভ করছেন স্থানীয় পাইকাররা। অথচ বাজার থেকে ভোক্তাদের সেই সবজি কিনতে হচ্ছে দ্বিগুণ দাম দিয়ে।

রংপুর অঞ্চলের মধ্যে মিঠাপুকুর উপজেলা সবজি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এরপরেই গংগাচড়া। এই দুই উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় এবং স্থানীয় বাজার ব্যবস্থার অভাবে ন্যায্য ম্ল্যু থেকে বেশিরভাগ সময় বঞ্চিত থাকেন কৃষকরা।
মিঠাপুরের মমিনপুর, বলদিপুকুর, জায়গীরহাট, বাড়ইপাড়া, তাজনগর, কোনাপাড়া, রানীপুকুর মির্জাপুর, গ্রামে গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, মুলা, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, সীম, গাজর, করলাসহ রকমারি শীতকালীন সবজিতে ভরে গেছে মাঠ। কৃষক-কৃষাণীদের ব্যস্ত সময় কাটছে সবজি ক্ষেত পরিচর্যায়। কনকনে শীতেও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে মাঠের কাজ। দম ফেলারও যেন সময় নেই তাদের। কেউ ক্ষেত থেকে ফসল তুলছেন, কেউ বা পরিচর্চা অথবার স্প্রে করছেন সবজি ক্ষেতে।

বর্তমানে সবজির দাম নিয়ে আলোচনা করে জানা যায়, কৃষক পর্যায়ে মুলা ২-৩ টাকা, পাইকারি ৫-৭ টাকা, ভোক্তা পর্যায়ে ২০ টাকা, পাতা কপি কৃষক পর্যায়ে ১০ টাকা, পাইকারি ১৫ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ২০ টাকা, ফুলকপি কৃষক পর্যায়ে ২০ টাকা, পাইকারি ৩০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৪০ টাকা, কাঁচা পিয়াজ কৃষক পর্যায়ে ৫০ টাকা, পাইকারি ৬০-৬৫ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। কাঁচা মরিচ কৃষক পর্যায়ে ৪০ টাকা পাইকারি ৫০ টাকা, ভোক্তা পর্যায়ে ৬০ টাকা, ঢোপা বেগুন কৃষক পর্যায়ে ৪৫ টাকা, পাইকারি ৬০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৮০ টাকা, চিকন বেগুন কৃষক পর্যায়ে ৪০-৪৫ টাকা, পাইকারি ৫৫-৬০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৭০ থেকে ৮০ টাকা, টমেটো কৃষক পর্যায়ে ২০ টাকা পাইকারি ৩০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, গাজর কৃষক পর্যায়ে ১৫ টাকা, পাইকারি ২০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৩০ টাকা, শিম কৃষক পর্যায়ে ২৫ টাকা পাইকারি ৩৫-৪০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মিঠাপুকুর উপজেলার বড়াইপাড়া এলাকার কৃষক জগদিস চন্দ্র রায় এবার দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি ও বাধাকপির চাষ করেছেন। জমি তৈরিসহ বীজ, সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য খরচ হয়েছে বিঘাপ্রতি প্রায় ২০ হাজার টাকা।

ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ক্ষেত থেকে যে দামে পাইকাররা কিনে নিয়ে যায়, তার দ্বিগুণ দামে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি করে তারা। এতে আমরাও ন্যায্য মূল্য থেকে যেমন বঞ্চিত হই, সেই সঙ্গে ভোক্তারা চরা দামে সবজি কিনছেন।

স্থানীয় পাইকাররা কৃষকের ক্ষেত থেকে লাউ সংগ্রহ করে ট্রাকে তোলার জন্য স্তূপ করছিলেন রানীপুকুর এলাকায়। এসময় কৃষক সবুজ মিয়া, মনসুর আলী ও মনোরঞ্জন জানান, স্থানীয় পাইকাররা তাদের কাছ থেকে প্রতিটি লাউ কেনেন ১০ থেকে ১৫ টাকায়। আর বাজারে গিয়ে সেই লাউ বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকায়।

স্থানীয় পাইকার রবিউল ইসলাম ও মোন্নাফ কবির সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা গ্রামের ক্ষেত ঘুরে ঘুরে প্রতিটি লাউ কৃষকদের কাছে ১০ থেকে ১৫ টাকায় কিনে বড় পাইকারদের কাছে বিক্রি করি ২০ থেকে ২৫ টাকায়। মাঝখানে প্রতিটি লাউয়ে আমাদের লাভ থাকে ১০ থেকে ১৫ টাকা।

প্রত্যেকটি সবজির ক্ষেত্রে এমনই হয় উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, বড় পাইকাররা সাধারণত এলাকায় আসেন না। মোবাইল ফোনে আমাদের সঙ্গে দাম ঠিক করে অনুমতি দেন। সবজি প্রস্তুত করে খবর দিলে তারা ট্রাক পাঠিয়ে দেয়। চুক্তি অনুযায়ী টাকা বুঝিয়ে দিয়ে সেগুলো নিয়ে যান। গাড়িভাড়াসহ আনুসাঙ্গিক খরচ হিসেব করে ঢাকার বিভিন্ন আড়তে সরবরাহ করেন তারা। বড়পাইকারদের সঙ্গে সরাসরি কৃষকদের কথা বলার সুযোগ নেই বলেও জানান তারা।

বড় পাইকার রমজান আলী জানান, এখানকার বিভিন্ন সবজি কিনে তিনি ঢাকার কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ীর আড়তে বিক্রি করেন। স্থানীয় পর্যায়ে ছোট ছোট পাইকারদের থেকে কিনে সেগুলো শ্রমিক দিয়ে পরিষ্কার করে ঢাকায় গাড়িতে করে পাঠাতে হয়। তাছাড়া গাড়িভাড়া বাড়ার কারণে প্রতিটি সবজির দাম আনুপাতিকহারে বেড়ে যায়।

কৃষকরা জানান, এমনিতে আবাদ করা শাকসবজি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই নানান সিন্ডিকেটের কারণে কমদামে বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। আগাম সবজি উত্তোলনের পর ওই জমিতে দ্বিতীয় দফায় শীতকালীন সবজি চাষ করা যায় উল্লেখ করে তারা জানান, ভরা মৌসুমে খুব একটা দাম পাওয়া যায় না। উৎপাদন খরচই ওঠে না অনেক সময়।

এদিকে, ঢাকার পাইকার সিন্ডিকেটের কারণে স্থানীয় পর্যায় বাজারগুলোতেও চড়া দামে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রংপুর জেলায় শাকসবজির আবাদ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। যা এখন বাজারে উঠতে শুরু করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুরের অতিরিক্ত উপ পরিচালক কৃষিবিদ মো: ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, রংপুর অঞ্চলে গত বারের চেয়ে চলতি বছর সব্জি চাষ প্রচুর হয়েছে ।  ফলন ও ভাল হয়েছে । কৃষক দাম ওপাচ্ছেন ভাল।