ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অস্ত্রধারী ২৩ রোহিঙ্গা কারাগারে

অস্ত্রধারী ২৩ রোহিঙ্গা কারাগারে

মিয়ানমারে চলমান সংঘাতে অস্ত্রসহ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারি মিয়ানমারের সেই ২৩ নাগরিকই রোহিঙ্গা। যারা কয়েকজন ছাড়া সকলেই কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীর বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের। অন্যান্যরাও কুতুপালং সহ বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা। এরা সকলেই রোহিঙ্গাদের বহুল আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ‘নবী হোসেন গ্রæপের সদস্য’ এবং অনেকেই বিভিন্ন মামলার আসামিও। বিজিবির দায়ের করা অস্ত্র মামলার এ ২৩ জনকে শনিবার বিকাল ৩ টার দিকে কক্সবাজার আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা এদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের কাছে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদনও করেছেন।

মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা, উখিয়া থানার ওসি, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সহ একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কমিউনিটি নেতা (মাঝি, সাব-মাঝি), একাধিক রোহিঙ্গা এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি, সীমান্ত এলাকার মানুষের সাথে আলাপ করে এসব বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।

মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা উখিয়ার থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) নাছির উদ্দিন মজুমদার জানিয়েছেন, বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের পালংখালী বিওপির নায়েব সুবেদার মো. শহিদুল ইসলাম বাদি হয়ে দায়ের করা অস্ত্র মামলায় ২৩ জনকে শনিবার বিকাল ৩ টার দিকে আদালতে আনা হয়েছে। এদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছে। রিমান্ড শুনানীর জন্য রবিবার সময় নির্ধারণ করেছেন বিচারক ফাহমিদা সাত্তার।

তিনি জানান, মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকালে অস্ত্র সহ গ্রেপ্তার এই ২৩ জন সকলেই রোহিঙ্গা। যারা উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং এর বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা। স্বাভাবিক কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে এসব রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের যাওয়ার কথা না। কিন্তু কি কারণে মিয়ানমারে গেল আর তাদের হাতে অস্ত্র কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহাফুজুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক অবস্থায় নানা মাধ্যমে নানাভাবে নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যে ২৩ জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে তারা সকলেই রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি মাধ্যম জানিয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রæপ রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এসব সন্ত্রাসীরা অপরাধ করেই মিয়ানমারে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে আত্মগোপনে থাকতো। এরাও এ ধরণের সন্ত্রাসী বলে দাবি করা হচ্ছে। ফলে এদের রিমা্েন্ড জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি হয়ে পড়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। তখন নিশ্চিত হওয়া যাবে এরা সন্ত্রাসী কিনা, আর হলেই কোন গ্রুপের সদস্য।

উখিয়া থানার ওসি মো. শামীম হোসেন জানান, ২৩ জনের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট নানা অপরাধে মামলা রয়েছে। বিস্তারিত তদন্ত চলছে। তদন্ত ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত জানা যাবে।

গ্রেপ্তার ২৩ জন কারা ?

বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের পালংখালী বিওপির নায়েব সুবেদার মো. শহিদুল ইসলাম বাদি হয়ে দায়ের করা অস্ত্র মামলার এজাহারে ২৩ জনের নাম, ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে। এজাহারে উল্লেখিত তথ্য মতে গ্রেপ্তার ২৩ জন হলেন, উখিয়ার বালুখালী ৮ নম্বর ক্যাম্পের মৃত কবির আহমদের ছেলে মো. হোসেন আহমদ (৩০), একই ক্যাম্পের মো. ইউনুসের ছেলে মো. রফিক (২৩), আ. রাজ্জাকের ছেলে আয়াতুল্লাহ (৩০), ৯ নম্বর ক্যাম্পের মো. রফিকের ছেলে মো. জুনাইদ (১৯), একই ক্যাম্পের নুর কালামের ছেলে মো. হারুন (২৩), সমসের আলমের ছেলে মো. কায়সার (১৯), রশিদ আহমেদের ছেলে মো. সাবের (১৯), ১০ নম্বর ক্যাম্পের আবদুল্লাহর ছেলে ওসামা (১৯), একই ক্যাম্পের জাফর আলমের ছেলে ওমর ফারুক (১৯), মো. তোহার ছেলে মো. সাদেক (১৯), মকবুল আহমদের ছেলে হারুন অর রশিদ (২৪), হামিদ হোসেনের ছেলে ইয়াসিন আরাফাত (১৯), দিল মোহাম্মদের ছেলে মো. ইসমাইল (১৯), মো. হোসেনের ছেলে মো. রহিম (১৯), ১১ নম্বর ক্যাম্পের আতা উল্লাহর ছেলে নজু মোল্লা (৩৮), ১৫ নম্বর ক্যাম্পের মো. সৈয়দের ছেলে সৈয়দ উল্লাহ (১৯), একই ক্যাম্পের দিল মোহাম্মদের ছেলে হাফেজ আহমেদ (১৯), ২০ নম্বর ক্যাম্পের মো. রশিদের ছেলে মো. জোবায়ের (১৯), কুতুপালং এলাকার ৬ নম্বর ক্যাম্পের ইউসুফের ছেলে আব্দুল্লাহ (২০), একই এলাকার ৩ নম্বর ক্যাম্পের আবুল হাসেমের ছেলে এনামুল হাসান (২২), ২ ক্যাম্পের ইমাম হোসেনের ছেলে মো. রফিক (২৪), একই ক্যাম্পের মৃত আবুল কালামের ছেলে সৈয়দুল ইসলাম (২৪), ৭ নম্বর ক্যাম্পের মৃত মো. জলিলের ছেলে মো. আরমান (২১)।

উদ্ধার ১২ অস্ত্র ও ৮ শত রাউন্ড গুলি :

এ ঘটনায় উদ্ধার হয়েছে ১২টি অস্ত্র। যেখানে রয়েছে, এসএমজি ৫টি, জি-৩ রাইফেল ১টি, পিস্তল ২টি, রিভলভার ৪টি। গুলির মধ্যে রয়েছে এসএমজি গুলি ১৯৮ রাউন্ড, এমজি গুলি ৯৮ রাউন্ড, রাইফেলের গুলি ২৭৬ রাউন্ড, জি-৩ রাইফেলের গুলি ১০৩ রাউন্ড, পিস্তলের গুলি ১৯৩ রাউন্ড, পিস্তলের বø্যাংক কার্তুজ ২৫ রাউন্ড, রাইফেলের গ্রেনেড ফিউজ ৫ রাউন্ড, এসএমজি ম্যাগাজিন ৬টি, এলএমজি ম্যাগাজিন ৪টি, জি-৩ ম্যাগাজিন ১টি, পিস্তল ম্যাগাজিন ২টি।

যা বলছেন রোহিঙ্গা নেতা ও স্থানীয়রা :

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য মতে, বালুখালীর এলাকাটি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নে অবস্থিত। এই বালুখালী এলাকার ৮, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর ক্যাম্প ঘীরে গড়ে উঠেছে বহুল আলোচিত শীর্ষ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন গ্রæপটি। রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের ঢেকিবনিয়ার মোস্তাক আহমদ ছেলে নবী হোসেন উখিয়ার বালুখালী ৮ নম্বর ক্যাম্পের বি বøকের ৪১ নম্বর ঘর বাস করতো। কিন্তু পরে তার নেতৃত্বে গড়ে উঠে সন্ত্রাসী গ্রæপ। এরপর একাধিক মামলা, রোহিঙ্গার সন্ত্রাসী গ্রæপ আরসা ও আরএসও’র সাথে বিরোধের জের ধরে নবী হোসেন তার চিহ্নিত সদস্যদের নিয়ে আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল। ফলে দীর্ঘদিন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তারের তৎপরতা চালালেও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এমনকি বিজিবির পক্ষে নবী হোসেনকে গ্রেপ্তারে তথ্য প্রদানকারিকে ১০ লাখ টাকা পুরষ্কারও ঘোষণা করেছিল।

পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘীরে নবী হোসেন অপরাধ করে বেড়ালেও সে ছিল আত্মগোপনে। বিভিন্ন সময় সীমান্তের মানুষ নবী হোসেন এবং গ্রæপের সদস্যদের রহমতবিল সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে আস্তানা করে থাকার দৃশ্য দেখেছেন। ওখানে মাদক মজুদ, বিভিন্ন সময় মানুষকে জিম্মি করে নির্যাতন করত নবী হোসেন। সীমান্তের যুদ্ধের কারণে তার সদস্যদের একটি অংশ অস্ত্র সহ আবারও বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যাদের জনতারদের সহায়তায় আটক করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। বিজিবির দায়ের করা মামলার ২৩ আসামি এরাই। এরাই নবী হোসেন গ্রæপের সদস্য।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) আলতাজ হোসেন জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনের নেতৃত্বে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একটি গোষ্ঠি দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে থাকতে বলা শুনা যেত। রহমতবিল সীমান্তের ওপারে এসব সন্ত্রাসীরা আস্তানা করে ছিল। সংঘর্ষের ঘটনার পর সেই গোষ্ঠিটি অস্ত্র সহ অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্পে প্রবেশ করেছে। যদিও একই চক্রের ২৩ অস্ত্রধারী রোহিঙ্গাকে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজন আটক করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সোপর্দ করেছে।

অস্ত্র সহ গ্রেপ্তার জুনাইদ, ওমর ফারুক, সাবের ও জোবায়ের চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং নবী হোসেনের খুব বিশ্বাস লোক বলে দাবি করেছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কমিউনিটি নেতা নুরুল হুদা। তিনি জানান, ক্যাম্পের চাঁদাবাজি, অপহরণের ঘটনার নেতৃত্ব দিতেন এরাই। এদের বিরুদ্ধে মামলাও আছে।

এছাড়া রহিম, আরাফাত, নজুও চিহ্নিত নবী হোসেন গ্রæপের সন্ত্রাসী বলে জানিয়েছেন নেজাম মৌলভী নামের বøক ভিত্তিক রোহিঙ্গা নেতা। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার অনেকেই সাধারণ রোহিঙ্গার কাছে খুব আতংকিত।

নবী হোসেন গ্রুপ নামে একটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ থাকার কথা স্বীকার করেছেন বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ৮ এপিবিএন এর সহ অধিনায়ক পুলিশ সুপার খন্দকার ফজলে রাব্বি। তিনি বলেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নবী হোসেন ও তার গ্রæপের সদস্যদের গ্রেপ্তারে তৎপর রয়েছে।

রোহিঙ্গা,কারাগার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত