আসছে বসন্ত, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং ২৬ মার্চ এই তিন দিবসকে ঘিরে সাভারের গোলাপ গ্রামে ব্যস্ত সময় পার করছে চাষীরা। গোলাপের বাম্পার ফলন হলেও অজানা ছত্রাকের আক্রমণের কারণে চাষীদের দিন কাটছে শঙ্কায়। ফাল্গুনের শুরু বসন্ত বরণ ও ভালবাসা দিবসের আগে পচন রোগে গোলাপ গাছের ডাল, পাতা ও কুঁড়ি ঝরে পড়ছে। ফুল ফুটলেও ছত্রাকের আক্রমণে গোলাপ ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যেসব ক্ষেতে গোলাপ ফুটেছে তার পরিমাণও কম। অতিমাত্রায় শীত, কুয়াশা ও অসময়ে বৃষ্টির কারণে গোলাপ ক্ষেতের এই সর্বনাশ ঘটেছে বলে দাবী চাষীদের। তবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভার উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এবছর ২৩০ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হয়েছে। ১৯৯০ সালে মিরপুর থেকে এসে বিরুলিয়ায় প্রথম গোলাপের চাষ শুরু করেন সাদেকুল নামের এক ব্যক্তি। তার বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ দেখে স্থানীয়রাও উদ্বুদ্ধ হয়ে শুরু করেন গোলাপের চাষ। চাষিরা লাভবান হওয়ায় ইউনিয়নের মোইস্তাপাড়া, সামাইর, শ্যামপুর, সাদুল্লাপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে গোলাপ চাষ। এখানে মেরিন্ডা, হাজারি, লিংকন, পাপা মিলন, বধূয়া বা হলুদ ও সাদা গোলাপের চাষ হয়। তবে বাজারে চাহিদা বেশি লাল মেরিন্ডার। এ গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষেরই প্রধান জীবিকা ফুল চাষ।
সরেজমিনে বিরুলিয়া ইউনিয়নের গোলাপ গ্রামের ছোট কালিয়াকৈর, বাঘ্নীবাড়ী, মইস্তাপাড়া, কাকাবর, সামাইর, সাদুল্লাহপুর, শ্যামপুর, আকরাইন সহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গোলাপ বাগান। সাদা ক্যাপ মোড়ানো গোলাপের কুঁড়ি বাতাসে দুলছে। গত বছরের তুলনায় এবছর গোলাপের উৎপাদন বেশি হয়েছে। তবে ছত্রাকের কারণে অধিকাংশ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গাছের পাতা, ডাল কিংবা কুঁড়ি পঁচে ঝরে যাচ্ছে। কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক স্প্রে করেও মিলছে না সমাধান। অনেক গাছের শাখা-প্রশাখা লালচে হয়ে আবার কালো হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও গাছের পুরো অংশই কালো হয়ে গেছে। কলি আসলেও ফুল না ফুটেই ঝরে যাচ্ছে।
কৃষকদের দাবি, কৃষি কর্মকর্তাদের জানিয়েও কিংবা তাদের দেয়া পরামর্শে প্রতিকার মিলছে না। অধিকাংশ কৃষকের অভিযোগ, কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে এসে কোন পরামর্শ দেন না বলে দাবী তাদের।
শ্যামপুর গ্রামের আব্দুল খালেক চার বিঘা জমি গোলাপ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, এবছর গোলাপ গাছে পঁচা রোগ লেগেছে। গাছের পাতা, ডাল, কুঁড়ি পঁচে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকমের ওষুধ দিয়েও আশানুরূপ কাজ হচ্ছেনা। তিনি আরও বলেন, কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরা এখানে পরিদর্শন করেন। তবে তারা কোন পরামর্শ কিংবা কোন কিছুই বলেন না। এখানে এসে তারা মরা ফুল, পাতা নিয়ে চলে যান।
এই গোলাপ চাষী আরো বলেন, কৃষি প্রধান এই দেশে সবকিছুরই গবেষণা করা হয়। কিন্তু গোলাপের উপর কোন গবেষণা নেই। লাখ লাখ টাকা খরচ করে গোলাপ ফুল চাষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়। এই শিল্প থেকে শত শত মানুষের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু অত্যান্ত দু:খের সাথে বলতে হয় গোলাপ ফুলে ছত্রাক কিংবা নানা রোগের যখন আক্রমণ ঘটে তখন এই শিল্প রক্ষায় কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় না। এই শিল্প রক্ষা নিয়ে কোন গবেষণা করা হয় না বলে তিনি আক্ষেপ করেন।
তবে নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রর করছেন বলেও জানান এই চাষী।
আরেক ফুল চাষী মাসুদ রানার দাবী করেন, লক্ষ্যমাত্রার তিন ভাগের এক ভাগ ফুলও তিনি তুলতে পারেননি। কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার আগেই সব পঁচে গেছে। যেটুকু ফুল ফুটেছিল তাও রোগাক্রান্ত, ফলে কাংক্ষিত দাম পাননি।
তিনি বলেন , এবছর অজানা ছত্রাক রোগের কারণে ফুল উৎপাদন কম হয়েছে। কিন্তু খরচ হয়েছে বেশি। প্রথমে গাছের পাতায় কিছু কালো দাগ আসে। এরপর ধীরে ধীরে পাতা পড়ে কান্ডে পঁচন লাগে। তারপর ফুল ফোটার আগেই কুঁড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
অপর এক ফুল চাষী নাজিমুদ্দিনের জানান , গত কয়েক দিন ধরেই বেচা-বিক্রি বেশি। তবে যতটুকু আমরা আশা করেছিলাম ততটুকু ফুল বিক্রি করতে পারছি না। গত কয়েক দিন আগেই প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টি ফুল তোলা গেছে। কিন্ত বর্তমানে ৫০টা পাওয়া যায়না। ছত্রাকের কারণে কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার আগেই সব পঁচে গেছে। এতে চাহিদা থাকলে বিক্রি করা যাচ্ছে না। এখন সঙ্কা কাজ করছে।
সাভার উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা মোছা: ইশরাত জাহান "আলোকিত বাংলাদেশ" কে জানান, সাভার উপজেলায় এবার ২৩০ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হয়েছে। এবছর প্রায় ৪০কোটি ফুল বিক্রি হবে বলে লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে। চাষীরা লাভবান হবে।
গোলাপে ছত্রাকের আক্রমণের ব্যাপারে জানান, "আমরা উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত সেখানে পরিদর্শন করা হয়। চাষীদের সাথে উঠান বৈঠক, বাগানের পাসগে, ফুল বাজারের পাশে ফেস্টুন সহ নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এছাড়া ছত্রাকের আক্রমণ ঘটলে কি ওষুধ প্রয়োগ করা হবে তার ব্যবস্থাপত্রও দেয়া হয় কৃষি অফিসের পিক্ষ থেকে।
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস ওয়াহিদ "আলোকিত বাংলাদেশ" কে জানান, "গোলাপ গ্রাম, এটা একটা বিখ্যাত বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে সাভারে। এখানে কোন কৃষক যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেক্ষেত্রে আমরা সরকারকে অবশ্যই অবগত করলে আমরা সরকার থেকে সহযোগিতা পেতে পারি। আর প্রোডাকশন যদি ফল করে তাহলে আমাদের কৃষি কর্মকর্তাকে অনুরোধ জানাবো যাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।"