ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিট কর্মকর্তাকে ডাম্পট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা 

সহকর্মীর শোকের মাঝেও পাহারায় বনকর্মীরা, অধরা পাহাড়খেকো চক্র

সহকর্মীর শোকের মাঝেও পাহারায় বনকর্মীরা, অধরা পাহাড়খেকো চক্র

কক্সবাজারের উখিয়ায় রাতের আঁধারে পাহাড়ের মাটি কেটে পাচারে বাধা দেয়ায় বিট কর্মকর্তাকে ডাম্পট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। ঘাতক ডাম্পারটি জব্দ করা হলেও এখনও পর্যন্ত পাহাড়খেকোচক্রের একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদেরও গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন বনকর্মী ও স্থানীয় সচেতন মহল। অন্যদিকে সহকর্মীর শোকের মাঝেও বন পাহারায় কাজ করছে বনকর্মীরা।

সূত্রমতে, গত তিন মাসে দুই ডজন ডাম্পট্রাক জব্দ করে মামলার আওতায় আনায় তার উপর চরম ক্ষুব্ধ ছিল পাহাড়খেকো চক্র। এতে করে পাহাড় খেকোচক্র হত্যার মিশন শুরু করে। পূর্ব নির্ধারিত ছক অনুযায়ী তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে রোববার রাতে ডাম্পার চাপায় বনকর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী মো. শফিউল আলম বাদি হয়ে উখিয়া থানায় পাহাড় খেকোচক্রের ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। সোমবার দুপুরে তিনি নিজেই বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি বিভিন্ন সংস্থার উপরিমহল দেখভালো করতেছেন।

সোমবার দুপুরে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেন বলেন, বন কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ।

নিহত বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান সজল (৩০) মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার মোহাম্মদ শাহজাহানের ছেলে। তিনি কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বনবিটের বিট কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। দুবছর আগে বিয়ে করা সাজ্জাদের নয় মাসের একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। তার সঙ্গে থাকা বনরক্ষী মোহাম্মদ আলীকে (২৭) আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে স্থানীয়রা স্থানীয়রা।

উখিয়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী মো. শফিউল আলম জানান, উখিয়ায় রাতের আঁধারে কোথাও না কোথাও অবৈধভাবে পাহাড় কাটা চলে। তাই রেঞ্জের সকল বিট কর্মকর্তারা রাতে নিয়মিত অভিযানে নামেন। প্রতিদিনের মতো শনিবার সেহরির সময় অভিযান টহলে যান উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান।

এ সময় খবর পান, এলাকার হরিণমারা লালুর বরোঘাটা এলাকা দিয়ে তুতুরবিল গ্রামের চিহ্নিত পাহাড়খেকো ছৈয়দ আলম ওরফে কানা ছৈয়দ পাহাড়ের মাটি ডাম্পট্রাক যোগে পাচার করছেন। মোটরসাইকেল চালিয়ে সাজ্জাদুজামান ও তার সহকারী সেখানে পৌঁছে ডাম্পট্রাকটি থামাতে সংকেত দেওয়ার সঙ্গে মাটিভর্তি গাড়িটি তাদের চাপা দিয়ে চলে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আহত হন সঙ্গে থাকা অপর বনকর্মী।

তিনি আরও জানান, তাদের চাপা দেওয়ার পর ডাম্পট্রাকটি ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে লামা-বান্দরবানে আত্মগোপনে চলে যাচ্ছিল। এ সময় বিজিবির সহায়তায় গাড়িটি জব্দ করা হয়।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিজলিয়া সড়ক দিয়ে ঢুকে ৪০ টি অবৈধ ডাম্পার দিনে রাতে পাহাড়ের মাটি ও বালি পাচার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। যে যেখানে পারছে বালি মজুত করছে। হিজলিয়া থেকে শুরু করে হরিনমারা হয়ে খয়রাতি পাড়া পর্যন্ত সড়কের দু পাশে মজুত করা রয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ বালি। এমন কোন জায়গা নেই যেখানে বালির মজুত নেই।

পাহাড়কাটা ও বালি পাচার কাজে নিয়োজিত অবৈধ ডাম্পার মালিকদের মধ্যে রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণ মারা ও বাগানের পাহাড় এলাকার মোহাম্মদ কোম্পানি, গফুর কোম্পানি, মাহমুদুল হক, ছৈয়দ করিম, মাস্টার কবির আহমেদ, বদু প্রকাশ ফিটিং বদু, শাহ আলম, কানা সৈয়দ করিম, হিজলীয়া একেএনসি স্কুল সড়ক ঠান্ডা মিয়ার ছেলে বাবুল, জাদিমোরা এলাকার সাইফুল কবির, আলিমোরার জামাল, হিজলিয়া মাজর পাড়া এলাকার মৌলভী রেজা। তাদের সহযোগি হিসেবে রয়েছে হিজলিয়ার আব্দুল্লাহ, হেলাল, রশিদ, তুতরবিল এলাকার সালাহ উদ্দিন, কুতুপালং এলাকার মংচানু বড়ুয়া, কুতুপালং পিএফপাড়া এলাকার সাগর বড়ুয়া সহ অনেকেই।

দক্ষিণ বনবিভাগের হিমছড়ি বন বিট কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান শোভন জানান, ময়নাতদন্তের পর রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিভাগীয় বন কার্যালয় মাঠে নিহত সাজ্জাদুজ্জামানের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সহকর্মী ও শুভার্থীরা অংশ নেন। একইদিন রাতে জানাজা শেষে তার গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে দাফন সম্পন্ন করা হয়।

উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী মো.শফিউল আলম বলেন, আমরা অবৈধ ডাম্পারের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছি। গত কয়েকদিন আগেও মাটি ভর্তি একটি ডাম্পার আটক করে মামলা দিয়েছে। বিট কর্মকর্তা সহ আমরা বনকর্মীরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সরকারের বনসম্পদ রক্ষার্থে।

তিনি আরও জানান, দোছড়ি বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদ সরকারি সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিজের প্রাণটা পর্যন্ত দিয়ে দিলো। অবৈধ ডাম্পার, বালি উত্তোলন,পাহাড় কাটা, অবৈধ সমিল সহ সবকিছুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এই অভিযান শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

কক্সবাজার সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা সমীর রঞ্জন সাহা জানান, বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদ একজন অমায়িক মানুষ ছিল। সহকর্মীকে হারিয়ে দেশজুড়ে বনকর্মীরা শোকাহত। তবুও শোকের মাঝেও বনকর্মীরা দেশের স্বার্থে বন রক্ষায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সারোয়ার আলম জানান, বনরক্ষা করতে গিয়ে সাজ্জাদ নিজের জীবন দিয়েছেন। তার নির্মম মৃত্যুতে আমরা একজন দক্ষ ও পরিশ্রমী বন কর্মকর্তাকে হারালাম। ঘাতক ডাম্পট্রাক চালক ও তার সহকারীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি তাদের গ্রেফতারে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে ফরেস্টার হিসেবে বন বিভাগে যোগ দেন সাজ্জাদুজ্জামান সজল। দোছড়ি বনবিটে গত বছরের শেষ দিকে যোগ দেয়ার পর থেকেই পাহাড় অধ্যুষিত উখিয়ায় পাহাড় ও বন রক্ষায় প্রায় প্রতিরাতেই অভিযান পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি। গত তিন মাসে দুই ডজনের মতো ডাম্পট্রাক জব্দ করে মামলার আওতায় এনে রেঞ্জ অফিসে রেখেছেন তিনি। একরাতে চারটি মাটিভর্তি ডাম্পট্রাক জব্দের ঘটনাও আছে তার। এসব কারণে তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ ছিল পাহাড়খেকো চক্র। যার ফলশ্রুতিতে তাকে গাড়িচাপায় হত্যার শিকার হতে হয়েছে বলে মনে করছেন তার সহকর্মীরা।

কক্সবাজার
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত