গ্রীষ্ম মৌসুম শুরুর আগেই ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে চট্টগ্রাম। নগরীতে দিনে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা, গ্রামে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। এতে বিপর্যস্ত জনজীবন। দিনদিন লোডশেডিং এর তীব্রতা বাড়ছে। গেল শনিবার থেকে লোডশেডিং বেড়ে যায়। শনিবার থেকে সোমবার তিন দিন লোডশেডিং ছিল অনেক বেশি।
পিডিবি বলছে, অফ পিক আওয়ারে লোডশেডিং নেই। পিক আওয়ারে ২২০ মেগাওয়াট করে লোডশেডিং করা হচ্ছে। তবে ক্যাব দাবি করেছে, চট্টগ্রামে চাহিদার বিপরীতে পিক আওয়ারে ৩৮০ মেগাওয়াট থেকে ৪২০ মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে।
লোডশেডিংয়ের তথ্য এড়াতে পিডিবি সরবরাহ ও ঘাটতির প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করছে না বলেও অভিযোগ করেছে ক্যাব। সংকট এড়াতে জরুরি ভিত্তিতে চট্টগ্রামে গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ আনার দাবিও জানানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মার্চের শুরুতে বিদ্যুতের লোডশেডিং তেমন ছিল না। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করত লাইনের নানা ধরনের ত্রুটির কারণে। পিডিবি এ সময় বলেছে লোডশেডিং নেই। লোকাল শেডিংয়ের কারণে বিদ্যুতের আসা-যাওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামে বিতরণ দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিতরণ দক্ষিণাঞ্চলে কক্সবাজার পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ২৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৪ হাজার ৪০৪ মেগাওয়াট। কিন্তু এসব কেন্দ্রে সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ দিনের বেলায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৩৩৬ মেগাওয়াট। পিক আওয়ারে অর্থাৎ বিকাল থেকে রাতের সময়ে উৎপাদন হচ্ছে ১ হাজার ৯৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) বলছে, গ্যাসের সরবরাহ চাহিদার চেয়ে কম। তাই এই মুহূর্তে চট্টগ্রামের গ্যাসভিত্তিক বন্ধ বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে পিডিবির বিতরণ দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম জানান, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। এ জন্য লোডশেডিং হচ্ছে। চট্টগ্রামে গ্যাসভিত্তিক ৪২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রাউজান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট বন্ধ। শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ। এসব কেন্দ্র পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ পেলেই কেবল চালু করা যাবে। গ্যাস না পাওয়া পর্যন্ত চালু করা যাবে না এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকবেই।
পিডিবি চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) আকতার হোসাইন জানান, পিক আওয়ারে এখন ২২০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। তবে অফ পিক আওয়ারে লোডশেডিং নেই। উৎপাদন বৃদ্ধি হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।গেল তিন দিন শনিবার, রোববার, সোমবার উৎপাদন আরও কমে গেছে। এর মধ্যে রাউজান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিটি ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিটই বন্ধ। এতে ব্যাহত হচ্ছে ৪২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন। গ্যাস সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ বলে জানা গেছে। ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র একটি ইউনিট চালু আছে। সেখানে দৈনিক উৎপাদন হচ্ছে ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স) প্রকৌশলী আমিনুর রহমান জানান, চট্টগ্রামে আমরা গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছি দৈনিক ২২০ মিলিয়ন ঘনফুট করে। চাহিদা অনেক বেশি। গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (সিইউএফএল) ও কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) দুটিই বন্ধ। গ্যাসভিত্তিক বন্ধ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করা জরুরি। কারণ এখন তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে রাউজান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও আরও কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। গ্যাসের পর্যাপ্ত পেলে বন্ধ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দ্রুত চালু করা হবে।
এদিকে চট্টগ্রামে তীব্র লোডশেডিং থেকে স্বস্তি দিতে জাতীয় গ্রিড থেকে দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সোমবার সংগঠনের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়। পবিত্র রমজানের আগে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বারবার নগরবাসীকে আশ্বস্ত করেছিল সার্ভিসের কোনো সংকট হবে না। কিন্তু মাস পেরোনোর আগেই চট্টগ্রামে ইফতার-সেহরিতেও নিস্তার নেই।তীব্র লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমেছে। সে কারণে চট্টগ্রামে দৈনিক ৩৮০ থেকে ৪২০ মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে সবসময়। পুরো দিনে বারবার লোডশেডিং হচ্ছে। অনেক সময় ঘণ্টায় দুই থেকে তিনবারও লোডশেডিং, যা তীব্র গরমে জনজীবনকে চরম অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সংকট এড়াতে জরুরিভাবে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানো জরুরি। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন, ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, ক্যাব মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু, সাধারণ সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, ক্যাব চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সভাপতি আলহাজ আবদুল মান্নান।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিদ্যুৎ বিভাগ একসময় লোডশেডিং শব্দটি বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ লাইনে ত্রুটি বা বিদ্যুৎ বিভ্রাট ব্যবহার করেছে। কিন্তু গ্রীষ্মকাল শুরুর সময়ে ভয়াবহ আকারে লোডশেডিং ফিরে এসেছে। এ কারণে চট্টগ্রামের বাকলিয়া ও কল্পলোক আবাসিক এলাকা, পাথরঘাটা, স্টেডিয়াম, ষোলশহর, কালুরঘাট, বাকলিয়া, মাদারবাড়ি, আগ্রাবাদ, হালিশহর, পাহাড়তলি, খুলশি, রামপুর, নিউমুরিং বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করছে। নগরীর বাইরে ফৌজদারহাট, হাটহাজারী, মোহরা, বাড়বকুণ্ড, সন্দ্বীপ, পটিয়া, সাতকানিয়া, দোহাজারী, বাঁশখালীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। একইভাবে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার বিতরণ বিভাগ এবং পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডের এলাকাগুলোতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এজন্য গ্রামাঞ্চলের মানুষের জনজীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত। দিন-রাত মিলিয়ে কোথাও কোথাও ছয় থেকে আট ঘণ্টা, কোথাও ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। এমতাবস্থায় সরকারের কার্যকরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন ক্যাব সদস্যরা।