বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে পৃথক ব্যাংক লুটের ঘটনায় পাহাড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে শান্তি কমিটির শান্তি আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা। বৃহস্পতিবার সকালে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সভা কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি। অন্যদিকে ব্যাংক লুটের ঘটনায় বান্দরবানের তিন উপজেলায় সচল থাকলেও রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচিতে সকল ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এই ঘটনায় অপহরণ শিকার ব্যাংক ব্যবস্থাপককে এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। একই সাথে হদিস নেই লুটকৃত অস্ত্রের। যার কারনে ব্যাংক ব্যবস্থাপকের পরিবারের মাঝে চরম উদ্বেগ -উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্যাংক বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওসমান গণি।
পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা সাংবাদিকদের বলেন, সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ২০২৩ সালের ২৯ মে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে অরুণ সারকী টাউন হলে মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ৯ জুন স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফ’র মধ্যে কয়েক দফা ভার্চুয়াল মিটিংয়ের পর উভয় পক্ষের মতামতের ভিক্তিতে সরাসরি সংলাপে বসার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়।
২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর এবং পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ মার্চ দুই দফা সরাসরি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। উভয় সংলাপে কেএনএফ’র সকল প্রকার সশস্ত্র কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা ও অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত দুটি সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হয়। কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে চুক্তি ভঙ্গ করে বিভিন্ন সময় সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। কমিটির তরফ থেকে এ বিষয়টির ব্যাপারে বারবার অবগত করা হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। বরং বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, অপরহণসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে গেছে।
সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল রুমায় তারাবি নামাজিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, সরকারি কর্মকর্তা ও পথচারীদের জিম্মি করে হামলা, অর্থ লুটের উদ্দেশ্যে সোনালী ব্যাংকে হামলা, ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণ, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ১৪টি অস্ত্র লুট করে নেওয়া এবং ৩ এপ্রিল থানচি উপজেলায় স্থানীয়দের জিম্মি করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ ও দুটি ব্যাংক লুট করে কেএনএফ সদস্যরা।
এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানান তিনি। কয়েক দফায় চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় কুকি-চিনের সঙ্গে শান্তি কমিটির সকল শান্তি আলোচনা স্থগিতের ঘোষণা দেন তিনি।
বান্দরবান সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওসমান গণি বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে রুমা সোনালী ব্যাংকে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ব্যাংকের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুটপাট করে। ভল্টের টাকা নিতে না পেরে ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় থানচি সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে ফের হামলা চালায়।
তিনি বলেন, প্রথম অবস্থায় সোনালী ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার কথা শোনা গেলেও পরবর্তীতে গণনা করে দেখা যায় ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৮৯২ টাকা নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। সব মিলিয়ে গ্রাহক ও কর্মচারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় সকল ব্যাংক সাময়িক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, অপহরণের শিকার ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাজাহান জানান, অপহরণের শিকার ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধারে অভিযান চলমান রয়েছে।
দুই দিনেও স্বামী ব্যাংক কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিনের হদিস না মেলায় চরম আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর স্বজনদের। নিজাম উদ্দিনের স্ত্রী কলেজশিক্ষক মাইসুরা ইসফাত বলেন, ‘স্বামীর খোঁজ না পেয়ে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে চরম আতঙ্কে দিন কাটছে। তিনি জীবিত না মৃত, তা–ও জানি না। প্রশাসনের কেউ স্বামীর খোঁজ দিতে পারছে না। তাকে অক্ষত ফেরত চাই।
নিজাম উদ্দিন বান্দরবান রুমা উপজেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব উপভোগ করতেন বলে জানান স্ত্রী মাইসুরা ইসফাত। তিনি বলেন, ‘রুমায় এত ঘটনা ঘটলেও কখনো কল্পনা করিনি আমার স্বামীকে কেউ অপহরণ করবে। তিনি কাজপাগল ছিলেন।
নিজামকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানান, বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন। তিনি বলেন ‘আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করার, সব করা হচ্ছে।
বান্দরবানের থানচিতে ব্যাংকে ডাকাতির খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। এর ফলে রক্ষা পায় সোনালী ব্যাংকের ভল্টের প্রায় দুই কোটি টাকা। এছাড়া বিজিবির জন্য ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার ফয়সাল হুদাকেও অপহরণ করতে পারেনি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
বুধবার (৩ এপ্রিল) দুপুরে এই ঘটনার পর বিজিবির কড়া পাহারায় ভল্টের টাকাসহ সেটি বান্দরবান সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখায় পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে সন্ত্রাসীরা থানচি কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের ক্যাশ থেকে কয়েক লাখ টাকা লুট করেছে।
বিজিবি সদরদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা (মিডিয়া) মো. শরীফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, এদিন দুপুর ১টার দিকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানচি উপজেলা শহরে গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। পরে স্থানীয় কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকে প্রবেশ করে। ব্যাংকের সবাইকে জিম্মি করে ক্যাশে থাকা টাকা লুট করে। তবে কৃষি ব্যাংকের কোনো ভল্ট না থাকায় তারা সোনালী ব্যাংকে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। এসময় ব্যাংকের ম্যানেজার ফয়সাল হুদাকে জিম্মি করে ভল্ট ভাঙার চেষ্টা চালানো হয়।
তবে তাৎক্ষণিক বিজিবি সদস্যরা ঘটনার বিষয় জানতে পেরে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে তারা ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হন। বিজিবি কাছাকাছি পৌঁছালে বিষয়টি টের পেয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ভল্ট ও শাখা ম্যানেজারকে রেখে পালিয়ে যায়। পরে বিজিবি থানচি শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
এ বিষয়ে বলিপাড়া ব্যাটালিয়নের (৩৮ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল তৈমুর হাসান খান বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক আমাদের সদস্যদের ঘটনাস্থলে যেতে নির্দেশ দেই। তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেখান পৌঁছান। এর আগেই আমাদের উপস্থিতির খবর পেয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সোনালী ব্যাংকের ভল্ট ও ম্যানেজারকে রেখে পালিয়ে যায়।
সোনালী ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার ফয়সাল হুদা বলেন, সন্ত্রাসীরা ভল্টের চাবি না পেয়ে সেটি ভাঙার চেষ্টা করে। এসময় তারা আমাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখে। তবে বিজিবি আসছে এমন খবর পেয়ে তারা পালিয়ে যায়।
জানা গেছে, কৃষি ব্যাংক থেকে দুই লাখ ৪২ হাজার টাকা এবং সোনালী ব্যাংক থেকে আনুমানিক ১৫ লাখ টাকা ডাকাতরা নিয়ে গেছে।
লে. কর্নেল তৈমুর হাসান খান আরও বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগে পুরো শহর নিয়ন্ত্রণে নিই। এরপর ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে ব্যাংকের ভল্ট বান্দরবান শহরে নিরাপত্তা দিয়ে পৌঁছে দেই।
শহরের নিরাপত্তা ও অভিযুক্ত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে বিজিবির কী ভূমিকা থাকবে- জানতে চাইলে তৈমুর হাসান খান বলেন, আমরা নিরাপত্তা জোরদার করেছি, টহল অব্যাহত থাকবে। আর অভিযুক্তদের শনাক্তে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আমরাও কাজ করছি।