রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় সব গাছে এবার মুকুল এসেছিল অনেক দেরিতে। সে সময়ও চাষিরা হতাশ হয়ে গিয়েছিল। এখন আমও কম দেখা যাচ্ছে। যার অধিকাংশ ঝড়ে পড়ছে তীব্র দাবদাহে। আর এতে আবারও হতাশ হয়ে যাচ্ছেন আমচাষিরা।
আমচাষিরা বলছেন, এবার ফাল্গুনের অনেক পরে আমের মুকুল দেখা গেছে। কিন্তু বৈশাখের শুরুতে আমের গুটি দেখা গেলেও এখন তা ঝড়ে পরছে তীব্র গরমের কারণে। আবার বিভিন্ন পোকার উপদ্রব আছে। এখন গাছে যা আম আছে তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে তাদের পক্ষে।
আমচাষিরা বলেন, আম রক্ষায় অনুমোদিত মাত্রায় ওষুধ ছিটিয়েও কাজ হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে চাষিরা অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ ছিটাচ্ছেন। পোকার আক্রমণের এবার আমের উৎপাদন কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, এ বছর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর এই চার জেলায় ৯৩ হাজার ২৬৬ হেক্টর জমিতে আম বাগান আছে। এগুলোতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর এ অঞ্চলে আম উৎপাদন হয়েছিল ১২ লাখ ৭ হাজার ২৬৩ টন। এবার উৎপাদনে ভাটা পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কৃষি বিভাগের হিসেবে চলতি মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। ৪ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা করা যচ্ছে। আম উৎপাদনকারী আরেক জেলা নওগাঁয় এবার বাগান রয়েছে ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। এখানে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর রাজশাহীর ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমির আমবাগান থেকে এবার ২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে বলে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা আশা করছেন। হিসাবমতে, ৮৫ শতাংশ গাছে আমের মুকুল এসেছে। এখন আমও আছে। কিন্তু কৃষকরা বলছেন আম ঝরে পড়ছে।
রাজশাহী জেলার বেশির ভাগ আমের বাগান চারঘাট ও বাঘা উপজেলায়। বাঘা উপজেলার বড় আমচাষি সাদি এন্টারপ্রাইজ কয়েক বছর ধরে বিদেশে আম রফতানি করছে। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আসাফুদ্দৌলা বলেন, এবার বেশির ভাগ গাছে কোনও আম নেয়। ওই সব চাষি গাছের কোনও পরিচর্যা করছে না। ফলে পোকামাকড় যে গাছে আম রয়েছে, সেই গাছেই হামলা করছে। কীটনাশক ছিটানোর ৭ দিনের মধ্যেই আবার অন্য বাগান হতে এসে আক্রমণ হচ্ছে। উপর্যুপরি এই আক্রমণের ফলে অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করে কোনও ফল পায়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এখন বাগানে মাছি পোকা, লেদা-পোকানাশক বিষ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।
এবার ভালো আম ধরেছে বাঘা উপজেলার আড়পাড়া গ্রামের বড় আমচাষি আনোয়ার হোসেনের বাগানে। তিনটি ড্রাম থেকে মেশিনের মাধ্যমে তিনি তার আমগাছে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কীটনাশক ছিটানোর জন্য তিনি বিশেষ আয়োজন করেছেন। এভাবে কেন কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে, জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, হপার পোকা তার আমের অনেক ক্ষতি করেছে। এখন নতুনভাবে আম ছিদ্রকারী পোকা উড়ে এসে হুল ফুটিয়ে চলে যাচ্ছে। এখন এই পোকার আক্রমণ শুরু হয়েছে।
ওষুধের গুণগত মান কমে গেছে। অল্প মাত্রায় কাজ হচ্ছে না। আবার দামও বেড়ে গেছে ৩০ শতাংশ। সব গ্র“পের ওষুধের দাম বেড়ে গেছে। শ্রমিকের দাম বেড়েছে। চাষিরা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই জন্য মানুষ আমগাছ কেটে অন্য আবাদে যাচ্ছেন। যাদের কম জমি, তারা শেষ হয়ে যাবেন।
রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও শাহ কৃষি পাঠাগার ও জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর শাহর আমবাগান রয়েছে রাজশাহীর পাশের জেলা নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীগ্রামে। তিনি বলেন, অনুমোদিত মাত্রার বাইরে তিনি ওষুধ ব্যবহার করেননি। তাঁর শ্রমিকেরা তাঁকে আগেই সতর্ক করেছিলেন যে শুধু অনুমোদিত মাত্রায় ওষুধ দিয়ে পোকার আক্রমণ থেকে আম বাঁচানো যাবে না। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে। তাঁর বাগানের সব আম পোকায় শেষ করে দিয়েছে।
বাঘা উপজেলার আরেক আম চাষী শফিকুল ইসলাম সানা। গত বছর প্রায় এক কোটি টাকা আম বিক্রি করেছিলেন। তার মধ্যে ২৬ মেট্রিক টন আম বিদেশে রফতানিও করেছিলেন। এবারও শফিকুল ৩০০ বিঘা জমিতে আমের চাষ করছেন। তবে এবার গাছে গুটি কম থাকায় হতাশ তিনি। শফিকুল ইসলাম সানা জানান, গত বছর তার বাগানে প্রচুর আম হয়েছিল। সে তুলনায় এবার আম যে পাবেন না, তা গাছ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশিক্ষক কর্মকর্তা উম্মে সালমা বলেন, আমের যত মুকুল আসে, তত আম হলে গাছ তো ধরে রাখতেই পারবে না। অল্প যে মুকুল থাকে, তাতে আম এলেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়। পোকার উপদ্রব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন তো হপার পোকা ও অ্যানথ্রাকনোজ নামের একটা ছত্রাকের সংক্রমণ থেকে আম রক্ষার জন্য তারা অনুমোদিত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। তাতেই কাজ হওয়ার কথা। তা ছাড়া এখন খরা শুরু হয়েছে। চাষিরা সেচ দেবেন, মালচিং করবেন, বিকেলে বা সন্ধ্যায়গাছে পানি স্প্রে করবেন। এতেই কাজ হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট হয়ে সোনামসজিদ পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার সড়কের দুইপাশে শুধুই আমবাগান। বড় বড় এক বাগান অন্যটার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। বাগানে বাগানে বিশাল বিশাল সব গাছ। কিন্তু গাছে আম তেমন নেই।
আমচাষি মিজানুর রহমান জানান, এবার বাগানে প্রায় ৭০ ভাগ গাছে মুকুল এসেছিল। গত মার্চ মাসের ২০ ও ২১ তারিখে যে বৃষ্টি হয়েছিল, সেই বৃষ্টিতে সব মুকুল নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া যে আমগুলো গাছে ঝুলছিল, এর সিংহভাগ এখন তীব্র খরায় ঝরে যাচ্ছে। এতে খরচ উঠবে না।
শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর এলাকার আমচাষি শাহাদ হোসেন জানান, চলতি বছর ছয় বিঘার একটি বাগানে অল্প গুটি এসেছিল। সেই গুটি ধরে রাখতে লড়াই করতে হচ্ছে। প্রায় দিনই সেচসহ কীটনাশক স্প্রে করতে হচ্ছে। তারপরও গুটি ঝরা রোধ করা যাচ্ছে না। এতে আমের ফলন বিপর্যয় ঘটবে।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদও ফলন নিয়ে চিন্তা করছেন না। তিনি বলেন, গুটি কম এসেছে তা ঠিক। কিছু গুটি খরার কারণে ঝরেও পড়ছে। তারপরও যে পরিমাণ গুটি আসে তার একভাগ টিকে থাকলেও পর্যাপ্ত আম পাওয়া যাবে। কারণ, সব গুটি তো টেকে না। প্রতিটি মুকুল থেকে দুটি-একটি করে আম পাওয়া গেলেও চলবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান জানান, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় চাষিদের খুবই সতর্কতার সঙ্গে গাছ পরিচর্যা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গাছের গোড়ায় নিয়মিত সেচ দিতে হবে। পাশাপাশি নানান ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ডা. পলাশ সরকার বলেন, চলতি মৌসুমে আমের অফ ইয়ার ধরা হয়েছে। কারণ গত বছর প্রচুর পরিমাণে আম এসেছিল। এবার মুকুল ও গুটি কম এসেছে। সেই গুটি টিকিয়ে রাখতে মাঠ পর্যায়ে চাষিদের নানান পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছেন।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রে’র প্রধান বৈজ্ঞানিক-কর্মকর্তা ড. মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, এবার আম কম হবে। আমের অনেক মুকুল ও গুটি নষ্ট হয়ে গেছে। সেইসাথে টানা খরার পাশাপাশি এবার আমের পরাগায়নে সহায়ক সিনফিড মাছি যথেষ্ট পরিমাণ দেখা যায়নি। এছাড়াও গত মৌসুমে আমের ভালো ফলন হয়েছিল। এবার বেশির ভাগ গাছে নতুন পাতা এসেছে। তাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে, এবার নয়, আগামী মৌসুমে আমের ভালো ফলন হতে পারে।