কক্সবাজারের রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবু তাহের দেওয়ানের আশকারায় গড়ে উঠেছে উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কাওসার ও মো. আল আমিনের নেতৃত্বে 'সিভিল টিম'। এই টিমের সব কিছুই দেখভাল করেন ওসির আস্তাভাজন এসআই মো. আল আমিন।
এ ছাড়া এই টিমে রয়েছে উপ-উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুহাম্মদ ইমরান উদ্দিন, মো. আহসান হাবীব (কং/ ১০৯৯), পিপল দেব (মুন্সী) (কং/ ৫৩৯), রাকিব হোসেন (কং/৩৮৬), মো. তৌহিদুল ইসলাম (কং১১৭৮), মো. মাহমুদ (কং/৫৫৫), মো. আবু বক্কর (কং/ ২৪৭৩)। তাদের ছত্রছায়ায় পুরো রামু উপজেলাজুড়ে চলছে নানা অপরাধ। এই সিভিল টিমের সহযোগিতায় রামুর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা, গরু, সিগারেট পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনকি রাতে মাটি পাচারেও সহযোগিতা করে আসছে এই সিভিল টিম।
এছাড়া এই টিমের লোকজনের বিরুদ্ধে ইয়াবাসহ লোকজন ধরে থানায় এনে ছেড়ে দেয়া এবং জব্দকৃত ইয়াবাও বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে এই টিমের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আল আমিনের বিরুদ্ধে ইয়াবা সংশ্লিষ্টার অভিযোগ এনে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখায় কয়েকটি অভিযোগ জমা পড়েছে। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, খোদ জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার মাঠ পর্যায়ের লোকজন এসআই আল আমিনের বিরুদ্ধে ইয়াবা সংশ্লিষ্টার অভিযোগ তুলে প্রতিবেদন দিয়েছেন। পুলিশের প্রকাশ্যে এইসব কর্মকান্ডে স্থানীয় সচেতন মহল সহ খোদ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরাও অতিষ্ঠ।
অভিযোগে প্রকাশ, ওসির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এসআই কাওসার ও এসআই আল আমিন। তাদের উপস্থিতিতে গরুসহ বিভিন্ন অবৈধ মালামাল পাচারে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র মতে, ইতিমধ্যে এসআই আল আমিন বান্দরবনের ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়িতে চাকুরী করার সুবাধে নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়া উপজেলার মাদক ব্যবসায়ীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে।
স্থানীয়দের তথ্য মতে, দুই দফা ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়িতে চাকুরীকালীন সময়েও তার বিরুদ্ধে ইয়াবা সংশ্লিষ্টার অভিযোগ ছিল। ওই সময়ে নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় তার কর্মস্থল হলেও প্রায় সময় কক্সবাজার -টেকনাফ সড়কে বালুখালী টিভি টাওয়ার এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে ইয়াবা উদ্ধারের নামে হয়রানীর অভিযোগ ছিল।
গত কয়েকদিনে রামু উপজেলায় অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কাওসার ও মো. আল আমিনের নেতৃত্বে 'সিভিল টিম' রয়েছে। দিনের বেলায় ওই টিমের সদস্যরা অনেকটা 'রুমবন্ধী' থাকেন। সন্ধ্যা হলেই সাদা পোশাকে নেমে পড়েন রামুর কয়েকটি পয়েন্টে। বিশেষ করে প্রতি সোম- বৃহস্পতিবার সপ্তাহিক গরুর হাট। নাইক্ষ্যংছড়ির প্রবেশদ্বার (চা বাগান) সহ কয়েকটি পয়েন্ট থেকে গরু বহনকারী যানবাহন আটকিয়ে টাকা উত্তোলন করতে দেখা গেছে। এছাড়া মিয়ানমারের সিগারেট পাচারে সহযোগিতা করে আসছে এই সিন্ডিকেট।
অনুসন্ধানে আরো দেখা গেছে, রাতভর পুরো উপজেলা থেকে ১০/১২ মাটি বোঝাই ডাম্পার ট্রাক আটক করে থানায় নিয়ে আসে। সকাল গড়াতেই দেনদরবারে ছাড়া পায় এসব ডাম্পার। অন্যদিকে রামু মরিচ্যা সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে ইয়াবা উদ্ধারের নামে হয়রানীর অভিযোগ রয়েছে এই সিভিল টিমের বিরুদ্ধে। গত ১৯ এপ্রিল মরিচ্যা সড়কের ঢালারমুখ এলাকা থেকে সিএনজির যাত্রী উখিয়ার নুরুল আবছারকে ইয়াবাসহ আটক করে। পরে থানায় এনে তাকে মোট অংকের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়। একই ভাবে গত ২০ এপ্রিল রামু- মরিচ্যা সড়কের পূর্ব রাজারকুল ব্রিজের উপর কক্সবাজার থ১১-৭৩৯৪ গাড়ির যাত্রী আবু ছৈয়দকে ইয়াবা সহ আটক করে। তাকেও থানায় এনে দেনদরবারে ছেড়ে দেয়া হয়। এরকম অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে এস আই আল আমিনের নেতৃত্বে সিভিল টিমের বিরুদ্ধে।
এছাড়া বিভিন্ন সময় জব্দকৃত ইয়াবা ও আরো অন্য বাহিনীর দেয়া মামলার ইয়াবা রামুর মন্ডল পাড়া এলাকার 'শাকিল' নামের একজনকে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। থানার জব্দকৃত ইয়াবা নয়ছয় করার সহযোগিতা করে আসছে থানার মালখানার দায়িত্বরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুহাম্মদ ইমরান উদ্দিন। ওসির আর্শিবাদে থানার মালখানার দায়িত্ব নেয়ার আড়াইমাসে এসআই মুহাম্মদ ইমরান উদ্দিনের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। আড়াইমাসে তিনটি মোটরসাইকেল বাইক ক্রয় করেছেন তিনি।
অন্যদিকে সিভিল টিমের মো. আহসান হাবীব (কং/ ১০৯৯), পিপল দেব (মুন্সী) (কং/ ৫৩৯), রাকিব হোসেন (কং/৩৮৬), মো. তৌহিদুল ইসলাম (কং১১৭৮), মো. মাহমুদ (কং/৫৫৫), মো. আবু বক্কর (কং/ ২৪৭৩) তাদের জীবন যাপনও অন্যরকম। নতুন ভার্সনের মোটর বাইক বাজারে আসলে প্রথমে তারাই কিনেন। তাদের জীবন যাপন দেখে থানার অন্য পুলিশ সদস্যদের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের মাইষকুম ব্রীজ আর রামু চা- বাগান নাইক্ষ্যংছড়ি যাওয়ার রাস্তার মাথায় প্রতি সোমবার আর বৃহস্পতিবারে প্রকাশ্যে গরু বহনকারী মিনিট্রাক হতে প্রতি গরু হিসাবে টাকা উত্তোলন করে।আর প্রতিদিন রাতে গরু গর্জনিয়া হইতে রামু বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সময় গরু পাচারকারীকে রোড ক্লিয়ার দেয় ওসির বিশ্বস্ত লোক কনস্টেবল মো. আবু বক্কর। মইষকুম এলাকা হইতে নদী পথে মনিরঝিল এলাকার পাহাড়ে দিনের বেলায় গরু রাখে এবং ওসির নির্দেশনা আর সময় মতো গরু বাহির করে। যেদিন বেশি গরু রামু থেকে পাচার হয় তখন ওসি নিজেই গরুগুলো রামু থানা এলাকার বাহিরে না যাওয়া পযন্ত বাহিরে থাকেন। যাতে ডিউটিরত কোন অফিসার ওই গরু আটক করতে না পারে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, থানার পাশে 'কলি স্টোর' নামের একটি বিকাশের দোকান রয়েছে। প্রায় সময় ওসির আস্তাভাজন কনস্টেবল মো. আবু বক্কর ওই দোকান থেকে মোটা অংকের টাকা পাঠায়।
সিভিস টিমের পাশাপাশি থানার সেকেন্ড অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কাওসার মামলা রেকর্ডের দায়িত্বও তার। ভুক্তভোগী লোকজন তার চাহিদা পুরন করলে ওই মামলা রেকর্ড হয়। এমনকি তার ইঙ্গিত পেলেই মামলা রেকর্ড করেন ওসি। খোদ গণমাধ্যমকর্মী আবুল কালাম আজাদের উপর হামলার ঘটনায় মামলা রেকর্ডেও হিমশিম খেতে হয়েছে। তার দায়েরকৃত মামলার আসামিদের গ্রেফতারের পর মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা, উপ-উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুহাম্মদ ইমরান উদ্দিন স্থানীয় মেম্বারের জিম্মায় দেয়ার অভিযোগ উঠেছে । এমনকি ওসি নিজেই আপোষ দেয়ার জন্য আবুল কালামের পরিবারকে চাপ দিচ্ছেন। মামলা আপোষ না দিলে তাদের বিরুদ্ধেও উল্টো মামলা নেয়ার হুমকি দিচ্ছেন ওসি। এমন অভিযোগ তুলেছেন হামলার শিকার সংবাদকর্মী আবুল কালাম আজাদ।
সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদের বোন জান্নাতুল বকিয়া বলেন, মামলা নথিভুক্ত হওয়ার পর এসআই মুহাম্মদ ইমরান উদ্দিন আসামী ধরতে যাওয়ার নামে তার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নেন। তাদের সহযোগিতায় তিনজন আসামিদের গ্রেফতারের পর স্থানীয় মেম্বারের জিম্মায় দিয়ে চলে আসে। বর্তমানে উক্ত আসামিগণ বাদিসহ আত্নীয় স্বজনদের নানা ভাবে হুমকি দিচ্ছে এবং প্রকাশ্যে ঘুরলেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ।
অভিযোগ উঠেছে, কনস্টেবল মো. মাহমুদ (কং/৫৫৫) এর চাহিদা পুরন না হলে মিলেনা পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। তাকে ৩/৫ হাজার দিলে মিলে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স। মঙ্গলবার বিকেলে রামু থানার সামনে দেখা হয় আবুল হোসেন (ছন্মনাম) এক যুবকের সাথে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ভোগান্তির কথা বলতে গিয়ে তার দু'চোখ থেকে জল আসে। তিনি বলেন, গত তিন দিন ধরে সে ঘুরতেছে। সব কিছু ঠিক থাকার পরও কনস্টেবল মো. মাহমুদের চাহিদা পুরন না হওয়ায় তার এই ভোগান্তি বলে মনে করেন। একই ভাবে দেখা হয় রবিউল (ছন্মনাম) একজনের সাথে তিনি ভোগান্তির কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রতিদিন এই ভাবে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের নামে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে।
অভিযোগের প্রসঙ্গে উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কাওসারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রামু থানায় সিভিল টিম থাকার প্রশ্নই আসে না। তবে তিনি ওসি প্রতিনিধি হয়ে থানার ডিউটি বন্টন সহ যাবতীয় কাজ করেন বলে দাবি করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, একজন সংবাদকর্মীর কাছে তথ্য যেতে পারে। এই গুলো ক্রস চেকিং করার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রামু থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আল আমিন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন। নানা কথার ফাঁকে প্রতিবেদককে থানায় যাওয়ার দাওয়াত দেন তিনি।
অভিযোগরের বিষয়ে জানার জন্য রামু থানার উপ-উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুহাম্মদ ইমরান উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি উপজেলা নির্বাচন (মহেশখালী) ডিউটিতে থাকায় কথা বলতে পারেনি। যার কারনে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে রামু থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবু তাহের দেওয়ানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার থানায় কোন সিভিল টিম নেই বলে দাবি করে বলেন, তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করেন। জড়িতদেন বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।