অবশেষে খুলে দেওয়া হল কালুরঘাট সেতুর ওয়াকওয়ে

প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৪, ১৯:২৭ | অনলাইন সংস্করণ

  চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত ও পুরোনো সেতুর মধ্যে কালুরঘাট সেতু অন্যতম। বিভিন্ন সময় নানা কারনে আলোচনায় আসে সেতুটি। সম্প্রতি এটি আলোচনায় ছিল এর সংস্কার ও কবে সেতুটি ব্যবহার উপযোগী হবে এ নিয়ে। প্রায় বছর খানেকপর বেশী সময় ধরে   সংস্কার কাজের সুবিধার্থে সেতুটিতে যান চলাচল বন্ধ আছে। লোকজন ফেরীযোগে নদীর এ পাড় হতে অন্য পাড়ে আসা যাওয়া করছে। তবে  আশার কথা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর ওপর শতবর্ষী কালুরঘাট সেতুতে নবনির্মিত ওয়াকওয়ে পথচারীদের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

সেতুর দক্ষিণ পাশ দিয়ে বিশেষ প্রযুক্তিতে নির্মিত ছয় ফুট চওড়া ওয়াকওয়ে দিয়ে চলাচল করতে পারছেন পথচারীরা। ওয়াকওয়ে চালুর ফলে ফেরি পারাপারের দুর্ভোগ থেকে অনেকটাই রেহাই পেলেন বোয়ালখালী ও পটিয়ার মানুষ।

বিষয়টি নিশ্চিত করে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু জাফর মিঞা বলেন, বুয়েটের পরামর্শে দৃষ্টিনন্দন কালুরঘাট সেতুর ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজটি শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে মানুষের চলাচলের জন্য তা খুলেও দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থীও নতুন ওয়াকওয়ে দেখতে যাচ্ছেন।

তিনি জানান, ওয়াকওয়ের নদীর পাশের অংশে সাড়ে চার ফুট উচ্চতার রেলিং রয়েছে এবং রেললাইন অংশে সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার রেলিং স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ওয়াকওয়ে দিয়ে চলাচলের সময় রেললাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করলেও পথচারীদের কোনো সমস্যা হবে না। 

এখন সেতুর উপর দিয়ে ট্রেনের পাশাপাশি একসাথে ওয়াকওয়ে দিয়ে পথচারীরাও পায়ে হেঁটে পার হচ্ছেন। সেতুর সংস্কার কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও ঈদের আগে থেকে ওয়াকওয়ে দিয়ে উভয় পাড়ের মানুষ চলাচল করছে। সাইকেল বা মোটরবাইক নিয়ে যাতে মানুষ ওয়াকওয়েতে যেতে না পারে, সেজন্য সেতুর উভয় দিকে তিনটি করে সিঁড়ি দেওয়া হয়েছে।

তবে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, খুলে দেওয়ার পর থেকে রেলিংয়ের ওপর অনেক তরুণকে বসে গল্প করতে দেখা যায়। একই সঙ্গে ওয়াকওয়ে দিয়ে অনেকে সাইকেল নিয়েও চলাচল করছেন। এতে পথচারীদের যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমন যেকোনো সময় দুর্ঘটনার শঙ্কাও রয়েছে।ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্র্যাস্ট্রাকচার লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মেহেদি হাসান বলেন, যেহেতু ওয়াকওয়ে দিয়ে উভয় পাশের পথচারীরা চলাচল করবে, তাই সাইকেল বা মোটরবাইকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে নদীতে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। এজন্য পথচারীদের সচেতন হতে হবে। প্রস্তুত করা হচ্ছে গাড়ি চলাচলের পথ।

পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু জাফর মিঞা বলেন, রেললাইনের মধ্যে কার্পেটিংয়ের কাজ চলমান। আশা করা যায় জুলাইয়ের মধ্যে সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। এরপরই কালুরঘাট সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তিনি আরও জানান, সেতুর দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য সেতুর উভয় অংশে আট ফুট উচ্চতার ব্যারিয়ার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে বড় গাড়িগুলো সেতুর ওপরে উঠতে পারবে না। এছাড়া কার্পেটিংয়ের কারণে যাতে সেতুর পাটাতন নষ্ট হয়ে না যায় সে জন্য সেতুতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি জানান, বুয়েটের নির্দেশনায় আমরা রেললাইনের ফাঁকের নিচে একটি প্লাস্টিকের পাইপ রেখেছি। পানি এ পাইপ দিয়ে নদীতে চলে যাবে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞ টিমের তত্ত্বাবধানে সেতুটির সংস্কার কাজ করছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। সেতুটিকে নতুনভাবে সংস্কার করে কক্সবাজার রুটে আধুনিক উচ্চগতির ট্রেন চলাচল উপযোগী করে তোলার জন্য বুয়েটকে ৮ কোটি টাকায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত বছরের ১ আগস্ট থেকে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিমের তত্ত্বাবধানে কালুরঘাট সেতুর সংস্কার কাজ শুরু হয়। সেতুটি নতুন করে সংস্কারের জন্য গত বছরের ১৮ জুন রেলওয়ের সাথে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। প্রথম দফায় গত বছরের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সেতুর সংস্কার কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে সংস্কার কাজ শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত বেশ কয়েক দফা পেছানো হয় সেতুটির সংস্কার কাজ। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর দাঁড়িয়ে প্রায় শতবর্ষী কালুরঘাট সেতু।

বোয়ালখালী উপজেলা ও পটিয়ার একাংশের কয়েক লাখ মানুষের শহরে যাতায়াতের মূল মাধ্যম এই সেতুটি। ২০২৩ সালের ১ আগস্ট সংস্কারের জন্য সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধের প্রথমদিন থেকেই মারাত্মক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে। প্রায় ১০০ বছর বয়সী কালুরঘাট সেতু দিয়ে ট্রেনের পাশাপাশি যানবাহনও চলে। একমুখী সেতুর একপাশে গাড়ি উঠলে আরেকপাশ বন্ধ থাকে। ফলে দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তি চলছে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে।

১৯৯১ সাল থেকে প্রত্যেক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের বিষয়টি রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে প্রার্থীদের প্রচারণা ও প্রতিশ্রুতিতে গুরুত্ব পেয়ে আসছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেতুর দাবি আরও জোরালো হয়। ২০১৪ সালে আন্দোলন শুরু করে ‘বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ’। নতুন সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তিন দফায় চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসন থেকে নির্বাচিত হওয়া জাসদ নেতা মঈনউদ্দিন খান বাদল ২০১৯ সালে মারা যান। এরপরের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা মোছলেম উদ্দিন আহমেদও ২০২৩ সালে মারা যান। সর্বশেষ একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুচ সালাম।

রেলওয়ের প্রকৌশলীরা জানান, প্রায় ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বুয়েট প্রকৌশলীদের পরামর্শে সংস্কার করা হচ্ছে কালুরঘাট সেতু। সংস্কারের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সংস্কারের প্রথম ধাপ শেষ করে গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজারগামী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। যানবাহন চলাচল ও পথচারী চলাচলের জন্য ওয়াকওয়ে নির্মাণ করতে সময় লাগে দীর্ঘদিন। কালুরঘাট রেল সেতু যানবাহন ও পথচারী চলাচলের জন্য প্রস্তুত হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সেতু প্রকৌশলী জিসান দত্ত। আগামী জুলাই–আগস্টে সেতুর উপর দিয়ে যানবাহনও চলাচল করতে পারবে বলে জানা গেছে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে সেতুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। ২০১১ সালে বুয়েটের একদল গবেষক আরেকবার ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিলেন সেতুটি। বর্তমানে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সেতুটি দিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে দ্রুতগামী ট্রেন চলাচল (নতুন সেতু নির্মিত না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন ও যানবাহন চলাচলের জন্য) করতে পারার মতো নতুন করে সংস্কার করা হচ্ছে।