সরেজমিন গর্জনিয়া-বাইশারী
টেকনাফে উদ্ধারকৃত জি-৩ রাইফেল যাচ্ছিল গর্জনিয়ার ডাকাত আবছার বাহিনীর হাতে
পাহাড় থেকে সারাদেশে অস্ত্র চোরাচালান চক্রের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৪, ১৫:৫৭ | অনলাইন সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
কক্সবাজারের টেকনাফে উদ্ধারকৃত জি-৩ রাইফেল যাচ্ছিল রামুর গর্জনিয়া এলাকার নুরুল আবছার নামের বিশাল একটি চোরাচালান চক্রের হাতে। এই চক্রটি একই এলাকার চোরাচালান চক্রের অপর গ্রুপের লিডার শাহীন ডাকাতদলের সদস্যদের ঠেকাতে অস্ত্র মজুদ করছিল বলে নাম প্রকাশ না করার অনিচ্ছুক একাধিক আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তা দাবি করেছেন। সরেজমিন রামুর গর্জনিয়া -বাইশারি এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এর সত্যাতাও মিলেছে। এই চক্রের সদস্যরা শুধু, কক্সবাজারে সীমাবদ্ধ নয়। দেশজুড়ে তাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে। টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ অস্ত্র সহ একজনকে গ্রেফতারের পর অস্ত্র চোরাচালান চক্রের বিশাল সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে। এমনকি এই চক্রের সাথে কক্সবাজার ক্রাইমজোন মহেশখালী উপজেলার অস্ত্র চোরাচালান চক্রের সদস্যারাও জড়িত রয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছেন।
টেকনাফ থেকে জি-৩ রাইফেল পাচারকালে পলাতক মুহাম্মদ জুয়েল রানাকে গত মঙ্গলবার রাতে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সে মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা, পন্ডিতের ডেইল এলাকার লুকমান হাকিমের ছেলে। পুলিশের তথ্য মতে, তার বিরুদ্ধে পূর্বেও দুইটি মাদক মামলা রয়েছে।
সূত্র মতে, গত সোমবার টেকনাফ থেকে সুপারি বস্তার আড়ালে পাচারকালে ১ টি বিদেশি জি-৩ রাইফেল, ৫০ রাউন্ড তাজা গুলি ও ২টি ম্যাগজিন সহ মো. হেলাল উদ্দিন(২৫)নামে একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার মো. হেলাল উদ্দিন রামু উপজেলার গর্জনিয়ার মনির আহম্মদের ছেলে। ওই সময় দুই'জন ব্যক্তি পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তাদের হাতে থাকা একটি সুপারি বস্তা সহ পালানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে হেলাল উদ্দিন নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। ওই সময় মুহাম্মদ জুয়েল রানা নামের একজন পালিয়ে যায়। এ সময় মো. হেলাল উদ্দিনের হেফাজত থাকা সুপারি' বস্তা থেকে ১ টি বিদেশি জি-৩ রাইফেল, ৫০ রাউন্ড তাজা গুলি ও ২টি ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়।
এই ঘটনা নিয়ে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গনি বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ধৃতসহ দুইজনকে আসামী করা হয়। ইতিমধ্যে পলাতক রানাকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরন করা হয়েছে।
কার হাতে যাচ্ছিল এই অস্ত্র, কেন?
সরেজমিন ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রামু উপজেলার গর্জনিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার বিশাল একটি চক্র গরু, ইয়াবাসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িত। তারা আবার এক পক্ষ অপর পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য সব সময় সক্রিয় থাকে। রামু গর্জনিয়া ঘিরে কয়েকটি অপরাধী চক্র সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্য নুরুল আবছার প্রকাশ ডাকাত আবছার ও শাহীন ডাকাত গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাদের মধ্যে গ্রুপিংও চলছে। শাহীন ডাকাত গ্রুপকে নিবৃত্ত করতে ছক আঁকে আবছার ডাকাত গ্রুপ। তার ধারাবাহিকতায় অস্ত্র মজুদের পরিকল্পনা করেন। গত সোমবার সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ থেকে অস্ত্র আনতে গিয়ে বিদেশি অস্ত্র সহ ডাকাত আবছার গ্রুপের সদস্য হেলালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই রানা নামের একজন পালিয়ে যায়। পরে তাকেও গ্রেফতার করা হয়। তারা দুইজনই কারাগারে রয়েছে। স্থানীয়দের তথ্য মতে, ডাকাত আবছারের লোকজনের হাতে ভারি অস্ত্র মজুদ রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, এই দুই গ্রুপের মধ্য ইতিমধ্যে কয়েকদফা সংঘর্ষও হয়েছে। এই ঘটনা নিয়ে মামলাও হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ডাকাত আবছার- ডাকাত শাহীনের পৃথক বাহিনী রয়েছে। ওই সদস্যরা প্রায় সময় পাহাড়ে অবস্থান করে। সুযোগ বুঝে এলাকায় ফিরে চোরাচালানের কাজ করে আসছে।
ডাকাত আবছার- ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে ডজন মামলা
পুলিশের তথ্য মতে, ডাকাত আবছার- ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে আবছারের বিরুদ্ধে রামু থানায় দুইটি হত্যা, একটি অস্ত্র, একটি ডাকাতি প্রস্তুতি ও একটি মারামারি মামলা রয়েছে। এছাড়া ডাকাত শাহীনের বিরুদ্ধে দুইটি অস্ত্র, একটি ডাকাতি, একটি ডাকাতির প্রস্তুতি ও ৩ টি মারামারি মামলা রয়েছে।
ডাকাত আবছার কোথায় থাকেন?
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ঝামেলা এড়াতে ডাকাত আবছার- ডাকাত শাহীন পাহাড়ী এলাকায় আস্তানা গেড়েছে। ডাকাত আবছার বেশিরভাগ সময় বাইশারী-ঈদগড়ের পাহাড়ী এলাকায় থাকেন। ঈদগড়ের রোস্তম মেম্বার তাকে এবং তার বাহিনীকে সহযোগিতা করে আসছে। এছাড়া আবছার ডাকাতের সহযোগী হিসাবে যাদের নাম আসছে মোহাম্মদ আবুল বশর, মোহাম্মদ মোস্তাক আহম্মদ যুবদল নেতা রাসেল, এরশাদ উল্লাহ, শওকত আলী, বিকাশ ফরমানসহ অনেকেই। স্থানীয়দের তথ্য মতে, বিকাশ ফরমানকে গ্রেফতার করলে ডাকাত আবছারের ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাবে। ছেলে পাহাড়ে থাকলেও তার অপরাধের সমস্ত অর্থ দাতা ও মদত দাতা হিসাবে কাজ করছে ডাকাত আবছারের বাবা নুর হোসেন।
অভিযুক্তদের বক্তব্যের জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তারা যা বলছেন: মামলার বাদী ও টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গনি বলেন, গত সোমবার জি-৩ রাইফেলসহ একজনকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর সূত্র ধরে পুলিশ কাজ করছে। আটক দুইজনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পুরো চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনার সহজ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা মুহাম্মদ ওসমান গনি আরো বলেন, পাহাড় থেকে সারাদেশে অস্ত্র চোরাচালান চক্রের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। এই কাজে টেকনাফ সহ কোন কোন এলাকার লোক জড়িত তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা ও টেকনাফ মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, অস্ত্র সহ ধৃত দুইজনের জন্যই ৭ দিনের রিমান্ডেের আবেদন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শুনানি হয়নি। তার মতে, ধৃতদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে অস্ত্র সহ চোরাচালান চক্রের শিকড় বেরিয়ে আসবে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উখিয়া সার্কেল) মো. রাসেল বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত যুবকদ্বয় বিভিন্ন ডাকাতদলের কাছে অস্ত্র ও গুলি বিক্রি করেন বলে স্বীকার করেন। তাদের দেয়া তথ্য মতে, পুলিশ কাজ করছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ( সদর সার্কেল) মো. মিজানুর রহমান বলেন, এই সব চক্রের বিরুদ্ধে পুলিশ সজাগ রয়েছে। নিয়মিত অভিযানও চলমান রয়েছে। তার মতে, ডাকাত আবছার- শাহীন ডাকাত পুলিশের খাতায় মোস্ট ওয়ারেন্ট অপরাধী। তাদের ধরতে পুলিশ নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রেখেছে।