চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ফাটল 

প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৪, ১৯:১৩ | অনলাইন সংস্করণ

  চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

চট্টগ্রামের অন্যতম মেগা প্রকল্প 'চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে' উদ্বোধন হওয়ার আগে নগরবাসী যেন আরেকটি দুঃসংবাদ পেল। সম্প্রতি 'এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে'র ফাটল দেখতে পেয়েছেন সংসদীয় উপকমিটির সদস্যরা। সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলারে ফাটল দেখেছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির গঠন করা উপকমিটির সদস্যরা। ফাটলের বিষয়ে আরও বিশদভাবে যাচাইয়ের জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নেবেন অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি। আর অনিয়ম ও ত্রুটিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তারা সাংবাদিকদের জানান। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি গঠিত উপকমিটির আহ্বায়ক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ ও মজিবুর রহমান মনজু  এক্সপ্রেসওয়ে পরিদর্শন করেন। বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) বেলা ১২টার দিকে পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে পরিদর্শন শুরু করেন কমিটির সদস্যরা। লালখান বাজার মোড়ে এসে পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সংসদ সদস্য এম এ লতিফ বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলারে যেসব ক্র্যাকের (ফাটল) কথা বলা হয়েছে, তা আমরা স্বচক্ষে দেখেছি।আপনারাও (গণমাধ্যমকর্মী) দেখেছেন। এটি টেকনিক্যাল (কারিগরি) বিষয়। আমরা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করব। তাঁদের মতামত নেব। এ সময় তাঁর সঙ্গে উপকমিটির অন্য দুই সদস্য সংসদ সদস্য মো. মজিবুর রহমান ও পারভীন জামান উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), ঠিকাদারি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও ছিলেন।উপকমিটির সদস্যরা তিন দিনের সফরে গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম আসেন। দুপুরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজার অংশ পর্যন্ত ঘুরে দেখেন তাঁরা।

এ সময় এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন অংশের কাজ তদারক করেন। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও চীনের র‌্যাঙ্কিন। নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত ১৬ কিলোমিটারের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের গুণগত মান যাচাই এবং অনিয়ম–দুর্নীতির বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়েছিল। সেই সব অভিযোগ তদন্ত এবং নির্মাণকাজের গুণগত মান যাচাইয়ে গত ১০ জুন উপকমিটি গঠন করে দেয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। উপকমিটির আহ্বায়ক করা হয় চট্টগ্রাম–১১ আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফকে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন বগুড়া–৫ আসনের সংসদ সদস্য মো. মজিবুর রহমান মনজু এবং সংরক্ষিত আসনের সদস্য পারভীন জামান। নগরীর লালখান বাজার অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কয়েকটি পিলারে ফাটল বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। সাংসদ এম এ লতিফ সাংবাদিকদের বলেন, গণমাধ্যমে ফাটল বিষয়ে যে প্রতিবেদন এসেছে, সেগুলো এবং নির্মাণ কাজে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না তা দেখতেই আমাদের সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছেআমরা পতেঙ্গা অংশ থেকে বিভিন্ন পয়েন্ট দেখেছি।  এক্সপ্রেসওয়ের উপরে দুপাশের সীমানা দেয়ালে যে ক্লাম লাগানো হয়েছে–সেগুলো মানসম্মত নয়। ফিনিশিংয়ে কিছু সমস্যা আছে। দুয়েক জায়গায় রডও বেরিয়ে আছে। এসব অসঙ্গতি প্রকল্প পরিচালক ও কনসালটেন্টকে দেখিয়েছি।ফাটলের বিষয়ে এম এ লতিফ বলেন, কিছু ফাটল এখানে (লালখান বাজার অংশের পিলারে) দেখেছি। ছবি তুলে নিয়েছি। আমরা বিশেষজ্ঞ নই। বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করব। আমাদের তিন মাস সময় আছে। নির্মাণ কাজে কোথাও কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না সব দেখে প্রতিবেদন দেব।

এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এতে কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না। অনিয়ম হলে জেল জরিমানাসহ সব শাস্তি হবে, সরকার কাউকে ছাড় দেবে না। প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের পাশাপাশি প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা করবেন উপ কমিটির সদস্যরা। এ ছাড়া চট্টগ্রামে নিজেদের মধ্যেও বৈঠক করবে কমিটি।পরিদর্শনের সময়ে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজে অসঙ্গতি দেখেছেন উল্লেখ করে কমিটির আহ্বায়ক সাংসদ এম এ লতিফ সাংবাদিকদের বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের ফিনিশিং কাজের (শেষ পর্যায়ের কাজ) ত্রুটিগুলো আমাদের চোখে পড়েছে। যানবাহন চালুর আগে নাট–বল্টুতে মরিচিকা চলে আসছে। আবার এক্সপানশন জয়েন্ট (এক্সপ্রেসওয়েতে সড়কের সমান্তরালে কংক্রিটের সংযোগস্থলগুলো মোড়ানো হয় ইস্পাতের পাত দিয়ে। একটি এক্সপানশন জয়েন্ট বলা হচ্ছে) পার হওয়ার সময় একটা বড় ঝাঁকুনি দেয়। অন্যান্য এক্সপ্রেসওয়েতে এই ঝাঁকুনি দেয় না। উপকমিটির প্রধান এম এ লতিফ বলেন, আমরা পতেঙ্গা অংশ থেকে বিভিন্ন পয়েন্ট দেখেছি। এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে দুই পাশের সীমানা দেয়ালে যে ক্ল্যাম্প লাগানো হয়েছে, সেগুলো মানসম্মত নয়।

ফিনিশিংয়ে কিছু সমস্যা আছে। দু–এক জায়গায় রডও বেরিয়ে আছে। এসব অসঙ্গতি প্রকল্প পরিচালক ও কনসালট্যান্টকে দেখিয়েছি। এক্সপ্রেসওয়েতে কোনো ধরনের অবকাঠামোগত ত্রুটি আছে কি না এবং থাকলে কারও গাফিলতি আছে কি না, তা উপকমিটি দেখবে বলে জানিয়েছেন সংসদ সদস্য এম এ লতিফ। তিনি বলেন, নির্মাণকাজ–সংক্রান্ত প্রতিটি বিষয় তাঁরা যাচাই করবেন। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরও সময় নেবেন। এরপর প্রতিবেদন সবার সামনে তুলে ধরবেন বলে জানান তিনি। পরিদর্শক দলের সঙ্গে থাকা সিডিএর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, এখানে যা আছে, তা ফাটল নয়, এয়ার ক্র্যাক। এ ধরনের স্ট্রাকচারে এ রকম ক্র্যাক (ফাটল) থাকে।

তারপরও ১২ টন ওজনের গাড়ি তুলে যাচাই করা হয়েছে, কোনো ফাটল নেই। ফিনিশিংয়ে কিছু ছোটখাটো বিষয় আছে। সেগুলো আমরা কনসালট্যান্ট ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে বলেছি। এগুলো অল্প সময়ে সংশোধনযোগ্য।নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ উড়াল সড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বোর্ড সভায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির নাম চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। গত বছরের ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি সাবেক ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী–সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেছিলেন। ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫টি র‌্যাম্প রয়েছে।  এর মধ্যে জিইসি মোড়ে একটি, টাইগারপাসে দুটি, আগ্রাবাদে চারটি, ফকিরহাটে একটি, নিমতলায় দুটি, সিইপিজেডে দুটি এবং কেইপিজেড এলাকায় দুটি র‌্যাম্প থাকবে। আর আগ্রাবাদ এলাকার চারটি র‌্যাম্পের মধ্যে জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর সড়কে একটি, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার সড়কে একটি এবং আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কে হবে দুটি র‌্যাম্প। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নগরীর প্রান্তটি নিচের মূল সড়কের ওপর দিয়ে লালখান বাজার মোড় পেরিয়ে ওয়াসার মোড়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে গিয়ে মিলবে। মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হলেও এখনো র‌্যাম্পগুলোর কাজ সম্পন্ন হয়নি। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের সাড়ে সাত মাস পার হলেও গাড়ি চলাচল শুরু হয়নি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দুইপাশে বসবাসকারী এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।