ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাড়ছে পানি, কাঁদছে মানুষ

ব্রহ্মপুত্রের ৩টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর

ব্রহ্মপুত্রের ৩টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর

ভারতের উত্তর সিকিমে ভারী বর্ষণসহ উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রংপুর অঞ্চলের প্রধান প্রধান নদ নদীর পানি ফের তৃতীয় দফায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। শতশত ঘরবাড়ী বিলীন হয়েছে ।দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট। পানিবন্দি পরিবারগুলো দুর্বিষহ জীবন যাপন।

এমনি দুর্বিষহ চিত্র দেখা যায় ও রংপুরের গঙ্গাচড়ার লালমিনরহাট নীলফামারী ও গাইবান্ধার, কুড়িগ্রাম সুন্দরগঞ্জে নদী পাড়ের মানুষদের। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়ে পড়েছে নতুন নতুন এলাকা। এতে চরম দূর্ভোগে পড়েছে হাজারও বানভাসি মানুষ ।

শুক্রবার বিকেলে রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের(পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিনের তুলনায় ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করেছে। কাউনিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ কিছুটা বাড়ছে ।

রংপুরের গঙ্গাচড়ার চারটি ইউনিয়নের প্রায় ১০০ পরিবারের ঘর-বাড়ি তিস্তায় বিলীন হয়েছে। ২৫০টিরও বেশি পরিবার ভাঙন আতঙ্কে তাদের ঘর-বাড়ি সরিয়ে নিয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে গঙ্গাচড়া উপজেলার প্রায় ৫ হাজার পরিবার। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে টিউবওয়েল, রান্নার চুলা, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট। পানিবন্দি পরিবারগুলো দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। এ ছাড়া পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে কয়েক বিঘা জমির বাদামখেত ও আমন ধানের বীজতলা।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, দেশের উত্তরাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারী এবং ৪৮ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানির প্রবাহ সাময়িকভাবে স্থিতিশীল থাকতে পারে। উপজেলার মর্ণেয়া ইউনিয়নের তালপট্টি, আলফাজটারী, নরশিং, হরিণচরা কোলকোন্দ ইউনিয়নের চর মটুকপুর, চর ছিলাখাল, মধ্য ছিলাখাল, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চর ইচলি, পশ্চিম ইচলি, চল্লিশসাল ও নোহালী ইউনিয়নের বাগডহরা, মিনার বাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায় বানভাসি ও বন্যায় ঘর-বাড়ি ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলোর দুর্বিষহ জীবন। গবাদিপশু-পাখি সঙ্গে নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন তাঁরা রাস্তার ধারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও বিভিন্ন খোলা স্থানে। ভাঙন হুমকিতে থাকায় আগে-ভাগেই অনেক পরিবার তাদের বাড়ি-ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

কথা হয় তিস্তার বন্যায় বাড়ি-ঘর ভেঙে যাওয়া মর্ণেয়া ইউনিয়নের আলফাজটারী গ্রামের আব্দুস সাত্তারের (৭৫) সঙ্গে। তিনি লেন, ‘ঈদের আগ থাকি নদীত পানি আসছে। হামরা মনে করছি এবার মনে হয় এদিকে ভাঙন আসবার নেয়। তিস্তা কয় থাকিস তোর বাড়িটায়, আগত ভাঙি নিয়া যাং। চোখের ইশারায় সবকিছু ভাঙি নিয়া গেইল যে বাবা।’ এ সময় তিস্তার বন্যায় বাড়ি-ঘর ভেঙে যাওয়া আজিজুল (৪০) নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘সেই ছোট্ট থাকি শুনি আসবার নাগছি যে সরকার হামার নদীটা বান্দি দেবে। কয়েক দিনে আগে শুননো, এবার নাকি নদীর কাজ শুরু করবে। এ জন্য পাকা বাড়ি বানাইনো, সে পাকা বাড়িত আর থাকিবার পাইনো না। খালি ইটগুলো খুলি নিছি তা ছাড়া সউগগুলো ভাসে নিয়া গেইছে।’

কোলকোন্দ ইউনিয়নের দুলালী বেগম জানান, তিস্তা নদী থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে তাঁর বাড়িটি ছিল। গতকাল রাতে রান্নাঘরসহ তিনটি ঘর নিমেষেই তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তিনি এখন তাঁর বাচ্চাদের নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন। মর্ণেয়া ইউনিয়নের বানভাসি মন্জুম আলী (৪৮) বলেন, ‘আমরা আজ ১০ দিন থাকি পানিবন্দি হয়া আছি। কেনো চেয়ারম্যান, মেম্বার সরকারি লোক ভুলকি মারিবারও আইসে নাই। ছোট্ট বাচ্চা, গরু-ছাগল এগুলা নিয়া খুব কষ্টে দিন পার করছি।’ গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ তামান্না বলেন, ‘আমাদের কাছে তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়া মর্ণেয়া ইউনিয়নের এখন পর্যন্ত ২০টি পরিবারের তালিকা আছে। আমরা আরও খোঁজখবর নিয়ে তালিকা করছি। তবে ভাঙনের হুমকিতে থাকায় কোলকোন্দ, নোহালী, মর্ণেয়া, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের ২৫০টির মতো পরিবার তাদের বাড়ি-ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।’

রংপুর-১ গঙ্গাচড়া আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান বাবলু মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমি তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমার এলাকার তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছেন। আমি সংসদ অধিবেশনের কারণে ঢাকায় আছি। আশা করছি আগামী ১১ তারিখে আমি নিজেই গিয়ে আমার তিস্তাপারের ভাঙনকবলিত এলাকাগুলো ঘুরে দেখব। আমি এখান থেকে সব সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কোথাও ভাঙনের খবর পেলে আমি সেখানে তাদের দ্রুত জিও ব্যাগ ফেলতে বলতেছি এবং তারাও সেখানে দ্রুত ভাঙন রক্ষায় কাজ করছে।’

অপর দিকে,কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি,পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমার এবং শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ধরলার পানি সামান্য হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বন্যার পানি প্রবেশ করায় জেলায় শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যার পানিতে প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। নদ-নদী তীরবর্তী চর ও নি¤œাঞ্চলের বসতভিটায় পানি প্রবেশ করায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে মানুষজন। অনেক পরিবার গবাদিপশুসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।

এছাড়াও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে, আমন বীজতলা, পাট ও মৌসুমি ফসলের খেত। কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ অবস্থায় দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাসিদের। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চরের বাসিন্দা জহুরুল ইসলাম বলেন,’ব্রহ্মপুত্রের পানি ঘরের চারপাশে আসছে। গবাদিপশু নিয়ে দুঃচিন্তায় আছি।’

বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মুসার চরের মতিয়ার রহমান জানান, আমার চরের প্রতিটি বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। কেউ নৌকা, কেউ বা মাচান করে উঁচু স্থানে রয়েছেন। এখানকার প্রতিটা পরিবার খুব কষ্টে আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রাকিবুল হাসান জানান, জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি আরও ৪৮ ঘণ্টা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। ব্রহ্মপুত্রের পানি তিনটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যন্য নদ নদীর পানি বিপসীমার নীচে রয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার জানান, এখন পর্যন্ত বানভাসিদের জন্য ৯ উপজেলায় ১৭৩ মেট্রিক টন চাল ও ১০ লক্ষ টাকা বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মজুত আছে ৬০০ মেট্রিক টন চাল ও ৩০ লাখ টাকা । যা পর্যায়ক্রমে বিতরন করা হবে। কয়েকদিনে ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পানি বেড়ে সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। অব্যাহত ভাঙনে পাটসহ বিভিন্ন ফসলি জমি ও বসতভিটা নদীতে বিলীন হচ্ছে। উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চ-ীপুর, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী। প্রতি বছর তিস্তায় পানি বাড়লে বা বন্যা দেখা দিলেই শুরু হয় নদীভাঙন। যে ভাঙন চলতে থাকে কয়েক মাসব্যাপী।

নদীপাড়ের মানুষের অভিযোগ, সরকার স্থায়ী ভাবে নদীভাঙন রোধে উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রতি বছর পাঁচ শতাধিক বসতবাড়িসহ কয়েক হাজার একর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে। উজান তেওড়া গ্রামের ফকরুল মিয়া বলেন, আমরা ত্রাণ চাই না নদী শাসন চাই। কাপাসিয়া ইউনিয়নের ডা. শরিফুল মিয়া বলেন, প্রতি বছর নদী ভাঙনে ভুক্তভোগী চরবাসীকে বার বার ঘর-বাড়ি সরাতে হচ্ছে। কিন্তু আজও স্থায়ী ভাবে নদীভাঙন রোধের কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, অনেকের ঘর তলিয়ে যাবার কারণে ঠিকমতো চুলাও জ্বলছে না। ফলে তাদের অনাহারেই থাকতে হচ্ছে। গবাদি পশুরও ঠিকমতো খাবার দিতে পারছেন না তারা। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. ওয়ালিফ ম-ল জানান, ফের তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। উপজেলার কিছু কিছু চরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের ভুক্তভোগীদের খোঁজখবর রাখতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে ত্রাণ সরবরাহ করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম জানান, ভাঙন ঠেকানোর জন্য উপজেলা প্রশাসনের তেমন করণীয় কিছু নেই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাউবো বিষয়টি জানানো হয়েছে। গাইবান্ধা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, ভাঙনকবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। তবে স্থায়ী ভাবে ভাঙন রোধে প্রকল্প নেওয়ার বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

শুক্রবার বিকেলে পাউবোর তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: আহসান হাবীব জানান গত কয়েক দিনের বৃষ্টি আর ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে প্রধান প্রধান নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে । তিস্তার পানি কোন কোন এলাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে । তিনি বলেন ব্রহ্মপুত্রের ৩টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ।

পানি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত