কক্সবাজারে পাহাড় ধসে তিনজনের মৃত্যু

প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪, ১৯:৪৯ | অনলাইন সংস্করণ

  স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার

ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, পাহাড় কর্তন ও বিভিন্ন সেবা সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে প্রতি বর্ষায় কক্সবাজারবাসীকে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বৃহস্পতিবার ভোর রাত থেকে ভারি  বর্ষণের তোড়ে পুরো পর্যটন শহর পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি ঢুকেছে বাসাবাড়িতে। নোংরা পানিতে নিমজ্জিত বসতঘর, ব্যবসা প্রতিষ্টানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, বসতঘরের মূল্যবান আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে। এমনকি কক্সবাজারের টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্টানে পানি ঢুকে বইসহ মূল্যবান কাগজপত্র নষ্ট হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। অনেক স্থানে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সড়ক-,উপসড়ক ও সংযোগ সেতু বিছিন্ন হওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে। বৃষ্টির তীব্রতায় কক্সবাজার শহর ও শহরতলী এলাকায় পৃথক সময়ে পাহাড় ধ্বসে নারী ও শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

কক্সবাজার পৌরসভার ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডে পৃথক এ পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটেছে। অন্যটি কক্সবাজার শহরের উপকন্ঠের লিংকরোড মহুরীপাড়া এলাকায়।

নিহতরা হলেন- শহরের ৬নং ওয়ার্ডের এবিসি ঘোনার দক্ষিণ পল্লানিয়াকাটা এলাকার মোহাম্মদ করিমের স্ত্রী জমিলা বেগম (৩০),  ৭নম্বর ওয়ার্ডের সিকদার বাজার এলাকার সাইফুলের ছেলে নাজমুল হাসান (৬) ও শহরতলীর মহুরিপাড়া এলাকার বজল আহমদের স্ত্রী লায়লা বেগম।

কক্সবাজার পৌর মেয়র মো. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী স্থানীয়দের বরাতে জানান, বুধবার রাতে থেমে থেমে হালকা বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। তবে, রাত ৩টা থেকে শুরু হয় টানা ভারী বর্ষন। প্রায় ৪ ঘন্টা চলে এ বৃষ্টি। টানা বর্ষণে পর্যটন জোনসহ পৌরসভার প্রায় এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ঘটে পাহাড় ধ্বসের ঘটনাও। সকাল ৭টার মাঝারি আকারে রূপ নেয় বৃষ্টি।

নিহত জমিলার স্বামী করিমের বরাতে স্থানীয় বাসিন্দা মনসুর বলেন, পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ পল্লানিয়াকাটায় নিজেদের বসতঘরে ঘুম হতে উঠে সবাই নাস্তার আয়োজন করছিলেন। এসময় আচমকা পাহাড়ের মাটি বসত ঘরে পড়লে চাপা পড়ে গৃহবধূ জমিলা। প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

অপরদিকে, পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের সিকদার বাজার এলাকায় বাড়ির মাটির দেয়াল চাপায় নাজমুল হাসান মারা যায়। পাহাড় ধসে ঘরের মাটির দেয়ালসহ আসবাবপত্র শিশু হাসানের গায়ে পড়ে। তাকে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মুহাম্মদ আশিকুর রহমান বলেন, মাটিচাপায় জখম পাওয়া দুজনের মাঝে শিশু নাজমুলকে সকাল পৌনে ৮টা ও নারী জমিলাকে পৌনে নয়টায় হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তারা মারা যান। দেয়াল চাপায় শিশু নাজমুলের মাথা থেঁতলে যায়। মরদেহ মর্গে রয়েছে। 

আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হান্নান জানান, কক্সবাজারে ভারী বর্ষণ চলছে। বৃহস্পতিবার ভোররাত ৩টা হতে সকাল ৯টা পর্যন্ত ১৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর মাঝে ৩টা হতে ৬টা পর্যন্ত ৮৫ মিমি আর ৬টা হতে ৯টা পর্যন্ত ৯৪ মিমি বৃষ্টিপাত হয়। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। 

কক্সবাজার পর্যটন জোনে দায়িত্বরত সার্জেন্ট মো. রোবায়েত হোসেন, ব্যবসায়ী ওবায়দুল হোসেন বলেন, কয়েক ঘন্টার টানা বৃষ্টিতে কলাতলীর পর্যটন জোনের প্রধান সড়কসহ উপসড়কগুলো হাটু পানিতে তলিয়ে যায়। পানি ঢুকেছে অনেক দোকান, অফিস ও বাসায়।

কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা এম. আজিজ রাসেল জানান, ড্রেনেজ ব্যবস্থা নাজুক থাকায় কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে পুরো টেকপাড়া, চাউলবাজার, বড় বাজার, পেশকারপাড়ার আশপাশ প্লাবিত হচ্ছে। রাস্তার উপর দিয়ে চলাচল করছে হাটু পরিমাণ পানি। পানি চলছে শহরের প্রধান সড়কের উপর দিয়েও। নালার উপর স্থাপণা করায় পানি চলাচল পথ সংকোচিত করায় নিষ্কাশনে বাধা পেয়ে পানি বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়ছে। এতে দামি আসবাবসহ বাড়ির সকল কিছু পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অধিবাসীরা।

এছাড়াও কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে শহরের কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোন, বাজারঘাটা, বার্মিজ মার্কেট, পেশকারপাড়া, হাশিমিয়া মাদ্রাসা, পাহাড়তলী, নুরপাড়া, সিটি কলেজ, বৌদ্ধ মন্দির সড়কসসহ ঝিলংজার বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে ভোগান্তির সৃষ্টি হতে দেখা গেছে।

কক্সবাজার শহর পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক মো. আলমগীর হোসাইন বলেন,পাহাড় ধ্বসে দুজন মারাযাবার কথা শুনেছি কিন্তু ঘটনাস্থলে যেতে পারিনি। বৃষ্টির তোড়ে ফাঁড়ি ভবনের নিচতলা তলিয়ে গেছে। পানি ঢুকেছে অফিসকক্ষসহ প্রয়োজনীয় সকল স্থানে। ডুবে রয়েছে রাস্তাঘাট।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা সমীর রঞ্জন সাহা বলেন, টানা ভারি বর্ষণে মেরিন ড্রাইভসহ বিভিন্ন স্থানে ৪০ টি স্পটে পাহাড় উপড়ে পড়েছে। এবং পাহাড় ধ্বংসে নারী-শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। পাহাড়ে বসবাসরতদের সরে যেতে বলা হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা রহমান বলেন,  সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় কিছু সংখ্যাক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।  সরেজমিন গিয়ে তাদের খোঁজ খবর নিয়েছি। স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারদের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে ইউএনও আরো বলেন, পাহাড়ে ধ্বংসে মারা যাওয়া দুই পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার শহর সভাপতি ইরফান উল হাসান বলেন, কক্সবাজার জেলায় কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। বর্ষা এলেই স্থানীয় প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে সরে যেতে মাইকিং করে। এছাড়া কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এমনকি জেলায় পাহাড়ে অবৈধ বসতি ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীর সঠিক পরিসংখ্যানও নেই সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, দেশের পর্যটন শিল্পের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন কক্সবাজার। কিন্তু এই শহরে আধাঘন্টা বৃষ্টি হলে অধিকাংশ সড়ক পানিতে একাকার হয়ে যায়। এ যেন কর্তা বাবুদের অপরিকল্পিত উন্নয়নের খেসারত দিচ্ছে মানুষ।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে যোগাযোগ করা হলে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ মো. তানভীর হাসান রেজাউল 'উন্নয়নে সমন্বয়হীনতার বিষয় উল্লেখ করে বলেন, এমনিতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। এর মধ্যে বছরজুড়ে  পাহাড় কর্তনের কারনে পাহাড়ের মাটি, বালি ড্রেনে পড়ে আটকে থাকে। যার কারনে সামান্য বৃষ্টি হলেই কক্সবাজারে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

যোগাযোগ করা হলে এলজিইডি কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন খান বলেন, ভারি বর্ষনে  রামু উপজেলার মনিরঝিল এলাকার একটি সংযোগ সেতুর পাশের মাটি সরে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে।  বিষয়টি ঊধ্বর্তন মহলকে জানানো হয়েছে। এছাড়া জেলার অন্য কোন স্থানের ক্ষয়ক্ষতির খবর আসেনি।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, টানা বর্ষণে পাহাড়ধসে মৃত্যু এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকাদের সরে যেতে মাইকিং করা হয়েছে। ভারী বর্ষণে প্লাবনের আশঙ্কাও রয়েছে। জেলার নদীগুলোতে ঢল নামলে এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকার আগাম প্রস্তুতি নিতে ইউএনওদের নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।