বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলার পাইকর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রাম পাঁচখুর। গ্রামের পূর্ব পুরুষদের চাষাবাদই ছিল মুল পেশা। লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এক খণ্ড, দু’খণ্ড জমিতে চাষাবাদ করে সংসার চালানো কষ্টদায়ক। অধিকাংশ পরিবারে অভাব অনাটন যখন নিত্যসঙ্গী তখন ভাবা শুরু করে কিভাবে ভালো থাকা যায়। মাথায় চিন্তা আঁটে নতুন কিছু করার। স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার নিমিত্তে তালের আঁশ দিয়ে নানা ধরনের পণ্য তৈরি করা শুরু করে দু’একটি পরিবার। তাদের পরিবারে ফিরে আসে স্বচ্ছলতা। ধীরে ধীরে এলাকার হাজারো আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ঝুঁকে পড়ে এ পেশায়।
উপজেলার ৪ গ্রামের প্রায় এক হাজার নারী-পুরুষ এসব পণ্য তৈরি করে নিজেদের ভাগ্য বদলাচ্ছেন। পাশাপাশি তালের আঁশ দিয়ে ৩৪৫ রকমের সামগ্রী তৈরি করে তারা স্বচ্ছলতাও পেয়েছেন। তালের আঁশ দিয়ে তৈরি পণ্য সামগ্রী যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ভাগ্যের চাকা ফেরাতে প্রত্যেক মানুষের চেষ্টাই যথেষ্ট। এর প্রমাণ মিলিছে কাহালুর প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে।
গ্রাম ঘুৃরে দেখা গেছে সড়কের দুই পাশে দেখা মিলবে শত শত তালগাছ। গ্রামের লোকজন সড়কের পাশে, ফাঁকা জায়গায় ও পতিত জমিতে তালের বীজ রোপণ করে আসছেন অনেক আগে থেকেই। এসব তালগাছের পাতার ডাঁটা থেকে বের করা আঁশ দিয়ে ঘরে বসেই নারী-পুরুষরা তৈরি করছেন নানা রকমের শৌখিন তৈজসপত্র। এই গ্রামসহ আশপাশের অন্যগ্রামগুলোতে তৈরি করা হচ্ছে তালের আঁশের টুপি, ফুলঝুঁড়ি, ম্যাট, স্যালেন্ডার, কিচেন, ওভাল ম্যাট, পানপাতা ম্যাট, বাকের ম্যাট, চাকা, ফুটকাপ, লন্ড্রিসহ প্রায় ৩৪৫ রকমের পণ্য সামগ্রী। গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই পণ্য সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত নারী-পুরুষ। তাল গাছের ঢিঙ্গা থেকে আঁশ বের করে তা দিয়ে তৈরি হরেক রকম জিনিসপত্র বৈশাখী মেলা, পূজা-পার্বনসহ বিভিন্ন উৎসবে বিক্রি হয়ে থাকে।
সাংসারিক ছোটখাটো কাজে ব্যবহারের জন্য ও ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এসব সৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করে স্বচ্ছলতা এসেছে এসব গ্রামের অনেকেরই। তাদের তৈরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া জার্মানী, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, চীন, দুবাই, সৌদিআরব, সিঙ্গাপুরসহ বিশে^র ১৪টি দেশে। স্থানীয়রা জানান, নারীদের তৈরি করা এসব তৈজসপত্র দেশে চাহিদা কম থাকলেও দেশের বাইরে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।
তৈজসপত্র বানানোর কারিগররা জানান, গ্রামের সব বাড়িতেই তালপাতার ডাঁটা থেকে পাওয়া আঁশ দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি হয় বছরের বারো মাস। তালপাতার ডাঁটা কিছুটা শুকানোর পর হাতুড়ি দিয়ে থেঁতলে আঁশ বের করা হয়। পরে তা রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় হরেক রকম তৈজসপত্র।
পাঁচখুর গ্রামের তৈরি এসব পণ্য সংগ্রহ করে রপ্তানিকারকদের সরবরাহ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা জানান, গ্রামের এই শিল্প প্রায় শত বছরের পুরানো। এক সময় টুপি এবং গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত পণ্য তৈরি হতো স্বল্প পরিসরে। দিনে দিনে চাহিদা বাড়ায় এখন তৈরি হচ্ছে বাহারি পণ্য। এই পণ্য এখন দেশ ছাড়িয়ে জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রকারভেদে এসব পণ্য ৫টাকা থেকে শুরু করে ১২০০টাকা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি হয়ে থাকে।
বগুড়ার পিইউপি সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী শেখ আবু হাসানাত সাইদ জানান, এ শিল্পতে টিকে রাথার জন্য সংস্থাটি আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া জার্মানী, ফ্রান্স ছাড়াও অনেক দেশেই বাংলাদেশে তৈরি তালের আঁশের সামগ্রীর চাহিদা রয়েছে। পণ্যগুলো পরিবেশবান্ধব হওয়ায় সবচেয়ে বেশি চাহিদা জাপানে।