বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের সাত বছর পূর্ণ হলো আজ রোববার। ২০১৭ সালের এদিনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতায় বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। নতুন ঢল ও পূর্বে কয়েক দফায় আসা রোহিঙ্গা মিলে উখিয়া-টেকনাফে এখন সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার বাস। রোহিঙ্গা আগমনের গত সাত বছরে কয়েক দফা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল প্রত্যাবাসনের। কিন্তু মিয়ানমারের টালবাহানা এবং রোহিঙ্গাদের নানা শর্ত ও অজুহাতে এ পর্যন্ত প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয়েছে।
তবে উখিয়া-টেকনাফ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ঘনত্ব কমাতে নোয়াখালীর ভাসানচরে গড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ইতিমধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে ১ লাখ রোহিঙ্গার আবাস গড়া হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। এদিকে যতই দিন যাচ্ছে, ক্যাম্পে বাড়ছে রোহিঙ্গা শিশু জন্মের হার।
গত ছয় বছরে ক্যাম্পে প্রায় দেড় লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে দাবি করেছেন ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট সংশ্লিষ্টরা।
সূত্রমতে, দিন দিন রোহিঙ্গা ইস্যুটি সরকারের জন্য বাড়তি বোঝা ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি বারবার উঠলেও সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় বের হচ্ছে না।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে পুরো কক্সবাজার অঞ্চলের স্থানীয়রা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনি ছাড়াও মাদক ব্যবসা, অপহরণ ও ধর্ষণের মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। গত সাত বছরে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহসহ ২৩৫ টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি তথ্যমতে, সাত বছরে ক্যাম্পে দুই শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিতে গিয়ে প্রায় ৮ হাজার একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। বিপর্যয় ঘটেছে পরিবেশের। এ কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে পাহাড় ধসের ঘটনাও।
অভিযোগ আছে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলে কিছু কার্যক্রম দেখালেও ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসী সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করে প্রত্যাবাসন ঠেকানোই তাদের মূল লক্ষ্য, এমনটি দাবি খোদ রোহিঙ্গাদের।
কুতুপালং মধুরছরার রোহিঙ্গা নেতা সালামত খান বলেন, ক্যাম্পে খুন ও বিশৃঙ্খলায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মদদ রয়েছে বলে আমরা খবর পাই। ইয়াবা ব্যবসায় যুক্ত রোহিঙ্গারা সকলেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সোর্স হিসেবে কাজ করছে। অনেকে এসব কথা জানলেও ভয়ে মুখ খুলেন না।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন, মিয়ানমারের বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন বাতিল, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রত্যাবাসনের পর আইডিপি ক্যাম্পের পরিবর্তে নিজস্ব গ্রামে ফিরে যাবার সুযোগ ও বসবাসের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করলে আমরা সব রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে প্রস্তুত।
এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। রোহিঙ্গারা তুচ্ছ ঘটনায় দলবেঁধে বাড়ি ঘেরাও করে স্থানীয়দের মারধর এবং অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে। এসব কারণে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন, কক্সবাজারে বাস করা রোহিঙ্গাদের শনাক্তকরণ, এনআইডি-জন্মনিবন্ধন-পাসপোর্ট বাতিল করে ক্যাম্পে ফেরত নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সূত্র মতে, গত ২ মাসে এসব ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অন্তত ১০ টি জি থ্রি রাইফেল সহ বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপি এ ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতে বিজিপি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগে এসব অস্ত্র রোহিঙ্গাদের কাছে পৌঁছে গেছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট এর পর থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ১১ ধরণের অপরাধে রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক ৩৮৩২ টি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৩৫ টি। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত খুনের মামলা হয়েছে ৩২ টি। এই ৭ মাসে অস্ত্র উদ্ধারের মামলা ৯৪ টি, মাদকের মামলা ১৬০ টি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক মামলার পরিসংখ্যা মতে ২০১৭ সালে ৭০টি, ২০১৮ সালে ২৪৯টি, ২০১৯ সালে ২৫৯টি, ২০২০ সালে ৩৪৯টি, ২০২১ সালে ৬২৪টি, ২০২২ সালে ১১৩৯টি, ২০২৩ সালে ৬৮৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার পরিসংখ্যা মতে অপরাধ ক্রমাগত বাড়ছে। গত ৭ মাসে ২৩৫ টি মামলার মধ্যে অস্ত্র ও খুনের মামলা সমুহ তদন্তকালে দেখা গেছে সশস্ত্র গোষ্ঠিগত সংঘাত কিছুটা বেড়েছে।
ক্যাম্পের নিরাপত্তায় থাকা এপিবিএন পুলিশ, জেলা পুলিশ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। গত ৭ মাসে ৩২টি খুনের মামলার বিপরীতে নিহতের সংখ্যা ৪৫ জন। এসব খুনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠণ আরসা ও আরএসও মধ্যে বিরোধের জের ধরে খুন হয়ে ৩৯ জন। অপর ৬ টি খুনের ঘটনা ভিন্ন। রোহিঙ্গাদের এই দুই সশস্ত্র গোষ্ঠি নিজের আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে। একই সঙ্গে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৬৬ জনই ওই দুই সংগঠনের সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও অস্থিরতা বেড়েছে। মিয়ানমার থেকে এপারে অস্ত্র আনার প্রমাণও মিলেছে অভিযানে। ফলে প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত এবং মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্যাম্প কেন্দ্রিক কঠোর নজরধারী, সশস্ত্র গোষ্ঠি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ সজাগ থাকার কথা বলেছেন অভিবাসন ও রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর।তিনি বলেন, ক্যাম্প কেন্দ্রিক কোন অপরাধ যেন না হয় এটা সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দিয়ে বাংলাদেশের জন্য হুমকি হবে সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠি।
সূত্র মতে, শরণার্থী হিসাবে বাংলাদেশে প্রথম রোহিঙ্গারা প্রবেশ করে ১৯৭৮ সালে। দ্বিতীয় দফা রোহিঙ্গারা আসে ১৯৯১-৯২ সালে। তৃতীয় দফা প্রবেশ করে ২০১৬ সালে। সর্বশেষ মোটাদাগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে। এবং সে সময় প্রায় দুই মাসে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আগের রোহিঙ্গা এবং নতুন করে আসা রোহিঙ্গা মিলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১১ লক্ষাধিক। বিগত ছয় বছরে নতুন করে জন্ম নিয়েছে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১৩ লক্ষাধিক, যার অর্ধেকের বেশি এসেছে ২০১৭ সালে।