নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আগুনে পুঁড়িয়ে দেয়া গাজী টায়ার কারখানার বিধ্বস্ত ছয় তলা ভবনটির ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলার ছাদের বেশ কিছু অংশ ধ্বসে তিন তলার ছাদের উপর পড়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) পরিদর্শন শেষে পুরো ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়ে শুধুমাত্র নীচতলার বেইজমেন্টে তল্লাশি করার পরামর্শ দেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রাকিব আহসান। পরে নীচ তলার বেইজমেন্টে তল্লাশি করে ফায়ার সার্ভিস কতৃপক্ষ। তবে ভেতরে কোন লাশ বা মানবদেহের অংশবিশেষ পাওয়া যায়নি।
এছাড়া বিভিন্ন ফ্লোরে ড্রোন দিয়েও তল্লাশি চালিয়ে কোন লাশ বা মানবদেহের অংশবিশেষ পাওয়া যায়নি। যে কারণে আপাতত উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারি পরিচালক। নীচতলার ভেতরে বেশ কয়েক জায়গায় এখনো আগুন জ্বলতে দেখা গেলেও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছেন এই আগুন আর ছড়াতে পারবে না।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) সকাল সাড়ে আটটায় তদন্ত কমিটির সদস্যদের সাথে উপজেলার রূপসি এলাকায় আগুনে পোঁড়া ভবনটি পরিদর্শনে আসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক সহ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা। এরপর ফায়ার সার্ভিসের লেডার মেশিনের মাধ্যমে ভবনের অবকাঠামো সহ প্রতিটি তলার ভেতরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন তারা। তবে কোন তলাতেই জীবিত বা মৃত কোন মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি।
পরে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহসান এসব তথ্য নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের জানান, ভবনটির ৪, ৫ ও ৬ তলার ছাদের বেশ কিছু অংশ ধ্বসে তিন তলার ছাদের উপর পড়েছে। যে কারণে দুই তলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত ভেতরে তল্লাশি করা বা এই মূহুর্তে ভেঙ্গে ফেলাও সম্ভব নয়। যে কোন সময় পুরো ভবনটি ধ্বসে পড়তে পারে। বর্তমান অবস্থায় ভবনটি রাজধানির বিজয় স্বরণির র্যাংগস ভবনের চেয়েও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়ে শুধুমাত্র নীচতলার বেইজমেন্টে তল্লাশি করার পরামর্শ দেন বুয়েটের সিভিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রাকিব আহসান।
এসময় সাথে ছিলেন জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট হামিদুর রহমান, রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান মাহমুদ রাসেল, গণপূর্ত বিভাগের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী ছাইফুল ইসলাম, কলকারখানা অধিদপ্তর উপ মহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র ঘোষ, তিতাসের উপ মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মঞ্জুর আজিজ মোহন ও পল্লী বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার হরেন্দ্র নাথ বর্মন সহ কমিটির অন্যান্য সদস্যরা।
বুয়েটের অধ্যাপক ও তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে চলে গেলে বেলা ১১ টার দিকে ভবনটির নীচতলার বেইজমেন্টে নিখোঁজদের সন্ধানে তল্লাশি শুরু করে ফায়ার সার্ভিস কতৃপক্ষ। ভেতরের বিভিন্ন অংশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেন কোন লাশ পাওয়া যায় কিনা। প্রায় আধ ঘন্টা তল্লাশির পর বেলা সাড়ে এগারোটায় ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারি পরিচালক আব্দুল মান্নান জানান, ভেতরে কোন লাশ বা মানবদেহের কোন ধরণের অংশবিশেষ পাওয়া যায় নি। তাই উদ্ধার অভিযান আপাতত শেষ করা হয়েছে। উর্ধতন কতৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ি তাদের পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
ফায়ার সার্ভিসের তল্লাশি অভিযানের সময় নীচতলার ভেতরে বেশ কয়েক জায়গায় এখনও আগুন জ্বলতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক আব্দুল মান্নান বলেন, ভেতরে কিছু কেমিক্যাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় স্বল্প পরিমানে আগুন জ্বলছে। তবে এতে ভয়ের কোন কারণ নেই। এই আগুন আর ছড়াতে পারবে না। তবে পরিস্থিতি ঠিক রাখতে আমরা কারখানার ভেতরেই অবস্থান করব। আমাদের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ পরবর্তী যে নির্দেশ দেবে সে অনুযায়ি আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান ও নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে নারায়ণগঞ্জের আদালত ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করার খবর ছড়িয়ে পড়লে দুপুরে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন কারখানার ভেতরে ঢুকে লুটপাট শুরু করেন। বিকেল চারটার দিকে বরাব এলাকা থেকে একটি গ্রুপ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে পুরো কারখানার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। এ নিয়ে আগে থেকেই লুটপাট চালানো দুর্বৃত্তদের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। পরে অস্ত্রধারীরা পিছু হটে। রাত নয়টার সময় বিদ্যুৎহীন অন্ধকার ছয়তলা ভবনটিতে শত শত লোক লুটপাট চালাতে থাকেন। এসময় কে বা কারা ভবনের নিচতলায় সিঁড়ির মুখে আগুন দিয়ে দেন। সেইসাথে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা টানা ৩২ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা চালিয়ে এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আর এই সময়ে কারখানার ভিতরে থাকা সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
আগুন লাগার পর কারখানার ভিতরে আটকে পড়া মানুষজনের স্বজনদের দাবির প্রেক্ষিতে নিখোঁজদের তালিক করা হয়। সেইসাথে স্বজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৫ জনের একটি তালিকা করেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স। তবে পরে ফায়ার সার্ভিস তালিকা তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নিখোঁজদের তালিকা করা হয়।
শিক্ষর্থীদের পক্ষ থেকে তালিকা করা মাহিমা মিম লিপা বলেন, নিখোঁজদের তালিকা নিয়ে গড়মিল হওয়ায় আমরা গত ২৭ আগস্ট তালিকা করা শুরু করি। সেইসাথে সেদিন আমরা ১২৯ জনের তালিকা করেছি। বুধবার (২৮ আগস্ট) আমরা নতুন করে তিনজনের তালিকা পেয়েছি। সবমিলিয়ে আমাদের কাছে ১৩২ জনের তালিকা রয়েছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান বলেন, যারা এখানে এসে বলছে তাদের স্বজনরা নিখোঁজ রয়েছে আমরা তাদের তালিকা লিপিবদ্ধ করে রাখছি। তবে নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না কতজন ভিতরে ছিলেন বা মারা গেছেন। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তাদের ড্রোন কিংবা তাদের মই দিয়ে দেখেছেন কোনো ডেডবডি নেই। আমরা মনে করতেছি যেহেতু এখানে অনেক কেমিক্যাল পোড়ানো হয়েছে কোনো মানুষ যদি থেকেও থাকে তাহলে ওইভাবে ডেডবডি পাওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই। কারণ ২১ থেকে ২২ ঘণ্টা টানা আগুন জ্বলছিল। সে হিসেবে নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। যারা স্বজনদের খুঁজে আসতেছেন আমরা তাদের নাম লিপিবদ্ধ করে রাখছি। পরবর্তীতে যখন ভিতরে কার্যক্রম চালাতে পারবো তখন বুঝতে পারবো আদৌ কেউ ছিল কিনা। এজন্য যদি স্বাস্থ্য বিভাগের কারও প্রয়োজন হয় তাহলে আমরা কমিটিকে কো-অপ্ট করে যুক্ত করবো।
কারখানার বাইরে ও ভিতরে নিখোঁজদের স্বজনরা লাশের খোঁজ করছেন। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তাদের ভবনের ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। বাইরে থেকেই শেষ সম্বল হিসেবে তারা লাশের অপেক্ষায় রয়েছেন।
রূপগঞ্জের বাসিন্দা আল আমিন এসেছেন তার চাচাতো ভাই মিজানের লাশের খোঁজে। তিনি বলেন, আমার চাচাতো ভাই মিজান প্রবাসে ছিল। কিছুদিন পূর্বে মালয়েশিয়া থেকে এসেছে। আগুন লাগার খবর শুনে এখানে দেখতে এসেছিল। কিন্তু এরপর থেকেই সে নিখোঁজ রয়েছে। এভাবে আমাদের এলাকারই ৬ জন নিখোঁজ রয়েছে। তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
কারখানার গেইটের কাছে কান্না করছেন নুরবানু বেগম। তিনি তার ছেলে নুর আলমের খোঁজে এসেছেন। তিনি বলেন, আমার তিন ছেলের মধ্যে এই ছেলেটাই আমার দেখাশোনা করতো। কারাখানায় আগুন লাগছে শুনে দেখতে এসেছিল। এরপর থেকেই সে নিখোঁজ রয়েছে। তার একটি মেয়ে রয়েছে। এখন তার মেয়েকে কে দেখবে আর আমাকেই কে দেখবে? আসছি দেখি লাশ পাওয়া যায় কিনা।