ঢাকার আশুলিয়ায় এক ডজন মামলায় অভিযুক্ত যুবলীগ কর্মী আনোয়ার হোসেন একের পর এক জমি জবর দখল নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে । যুবলীগের ওই কর্মী আশুলিয়া থানা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম-আহব্বায়ক মঈনুল ভূইয়ার অনুসারী বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সম্প্রতি সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই মুখ খুলতে শুরু করেছে এক সময়ে ভয়ে থাকা ভুক্তভোগীরা।
অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেন ঢাকার আশুলিয়া থানাধীন দক্ষিণ গাজিরচট এলাকার মৃত চাঁন মিয়ার ছেলে। সে আশুলিয়া থানা যুবলীগের যুগ্ন-আহবায়ক মঈনুল ইসলাম ভূঁইয়ার অনুসারী।
এক ভুক্তভোগী আশরাফুল আলম বলেন, গেল ১৫ আগস্ট বাইপাইল মৌজার ১১ শতাংশ জমি বায়না সূত্র মালিক হন তিনি। পরে ওই জমিতে সাইনবোর্ড দেন। গেল ২৬ আগস্ট চাঁন মিয়ার ছেলে আনোয়ার হোসেন এবং আশুলিয়া থানা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম-আহবায়ক মইনুল ইসলামের ভূঁইয়ার ম্যানেজার সুজন (৩৫) সহ অজ্ঞাত কয়েকজন তার সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলে এবং তাকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজসহ প্রাণ নাশের হুমকি দেয়। কোন উপায় না পেয়ে এ ঘটনায় তিনি থানায় লিখিত অভিযোগ দেন।
আশরাফুল আলম অভিযোগ করেন, গত ২০১০ সালের ১১ই নভেম্বর আশরাফ আলী মোল্লা (২৬) নামের এক যুবককে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় এজাহার নামীয় আসামী যুবলীগ কর্মী আনোয়ার হোসেন। আশুলিয়া থানার পুলিশ বাদি হয়ে করা মামলায় (নং ৩১) গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর আটক হয় আনোয়ার। পরে ২৯ই ডিসেম্বর ২দিনের পুলিশের রিমান্ড শেষে দীর্ঘদিন সাজা হয়।
এর আগে জমি দখলের পূর্ব শত্রুতার জেরে ২০১১সালের ১৪ই এপ্রিল রাতে আশুলিয়ার মধ্যগাজীরচট এলাকার মৃত আব্দুল জব্বারের ছেলে নূর মোহাম্মদ (৫০) ও তার সুপারভাইজার ইকবাল হোসেন (২৭) কে বাড়িতে ঢুকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা নিক্ষেপ ও গুলি করার ঘটনায় মামলা হয় আনোয়ার হোসেনের নামে। বোমার আঘাতে নূর মোহাম্মদের দুই উরুসহ অন্ডকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সুপারভাইজার ইকবালের বাম পা গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে আনোয়ার হোসেনের পিতা চাঁন মিয়াকে আটক করে পুলিশ। অস্ত্রসহ পালিয়ে যায় আনোয়ার হোসেন ও তার সহযোগীরা। ১৫ এপ্রিল ২০১১ ইং আহতের ছোট ভাই জসিম উদ্দিন আশুলিয়া থানায় চাঁন মিয়া ও তার ছেলে আনোয়ার হোসেন সহ অজ্ঞাত ২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা নং ৩৮(৪)১১করেন।
ভুক্তভোগীর ছোট ভাই জসিম উদ্দিন বলেন, তাদের ৮১ শতাংশ জমির মধ্যে ২৮ শতাংশ জমি জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করেছিলো আনোয়ার ও তার বাবা। পরে পুরো জমি দখল করতে চেয়েছিল তারা। এতে বাঁধা দিতে গেলে তাদের উপর হামলা করে। এসময় ঘটনাস্থল থেকে তাঁর বাবাকে পুলিশ আটক করে এবং তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও দেয়া হয়। সে পরবর্তীতে কোন এক অজানা কারণে দুই দুইবার মামলার তারিখে কোর্টে অনুপস্থিত থাকেন। পরে উচ্চ আদালতে আপিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরই মধ্যে চাঁন মিয়া মারা যায় এবং ক্ষমা চেয়ে ভুল স্বীকার করে দখলকৃত জায়গা ছেড়ে দেয় আনোয়ার। এজন্য আর আপিল করা হয়নি।
তিনি বলেন, এছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আশরাফ হোসেন চৌধুরীর বায়নাকৃত ১০৭ শতাংশ জমি দখল করতেও গিয়েছিলো। সে ঘটনায় ১১ই অক্টোবর ২০০৬ ইং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের প্রতিবেদনে বাবা-ছেলের নাম উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেয়া হয়।
২০২০ সালে যুবলীগের পরিচয়ে আশুলিয়া থানার বাইপাইল এলাকায় একটি মার্কেট দখল করতে গিয়ে ৫ লআখ টাকা চাঁদা দাবি করে মালিকের কাছে। পরে ৫ ফেব্রুয়ারি ওই মার্কেটের মালিক পক্ষের মাকসুদা নামের এক নারীকে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে মারাত্মক জখম করে। এঘটনায় আশুলিয়া থানায় ৬ই ফেব্রুয়ারি আশুলিয়া থানায় মামলা (নং ৩৩) দায়ের করেন ভুক্তভোগী। ওই মামলায় ৪ নং আসামী ছিলেন চাঁন মিয়ার ছেলে যুবলীগ কর্মী আনোয়ার।
ভুক্তভোগী নারীর ভাই ও মামলার বাদী ফারুক হোসেন বলেন, ‘তার বোনের মার্কেট দখলে নিয়ে তারা ভাড়া নিতো। দোকানদারদের ভাড়া দিতে বার বার নিষেধ করা হয় এবং যাদের কাগজপত্র সঠিক প্রমাণ হবে তাদেরকে ভাড়া দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। যেহেতু বিষটি বিচারাধীন। বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে যুবলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে তার বোনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে এবং হাত পা ভেঙে দেয়।
২০১০ সালে চান মিয়া ও তার ছেলে আনোয়ার হোসেনে, মৃত জুলফিকার আলী ভুঁইয়ার ছেলে ধানমন্ডির বাসিন্দা মোহাম্মদ শামসুল আলম ভূঁইয়া এবং স্ত্রী মিসেস ফয়জুন নাহারের, ১৯৯৮ সালে ৪৮৩২/৪৮২৪ নং দলিলমুলে ক্রয়কৃত বাইপাইল মৌজার ৫০ শতাংশ জমি, এই দম্পতির অনুপস্থিতির সুযোগে দখল করে। বাপ ছেলের জবরদখলের বিরুদ্ধে আদালতে ৪২৫/২০১০ মামলা করেন এই দম্পতি। আদালত চাঁন মিয়া ও আনোয়ার হোসেন গংদের এই সম্পত্তিতে অনুপ্রবেশ ও বাদী পক্ষের ভোগ দখলে কোন প্রকার ব্যাঘাত সৃষ্টি না করার আদেশ জারি করে। আদালতের আদেশ অমান্য করে চাঁন মিয়া সহ তার পুত্র আনোয়ার হোসেন গং শুরু করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম। হত্যার হুমকি সহ ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন এই দম্পতির কাছে। এ ঘটনা উল্লেখ করে ৩০শে জুলাই ২০১০ আশুলিয়া থানায় জিডি নং ২০০৫ দায়ের করেন দম্পতি। তাতেও কাজ না হওয়ায় ওই বছরের ৬ই অক্টোবর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এর দপ্তরে ডাইরি নং ৩৪২৭ চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের হাত থেকে জীবন ও সম্পত্তির রক্ষার আবেদন করেন ফয়জুন নাহার দম্পতি। পরে ১০ই অক্টোবর তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আবেদন পত্রে বলা হয়।
২০১৭ সালে ঢাকার বাসিন্দা মৃত হাজী আব্দুর রশিদ খানের দুই ছেলে আব্দুর রফিক খান এবং আশিকুর রহমান খানের আশুলিয়া থানার বাইপাইল মৌজার ৮৭৬৮ নং খতিয়ানে ১৯৮ ও ৯৭৩ দাগের ১১ শতাংশ একটি বাড়ি সহ জমি রয়েছে। তাদের অনুপস্থিতিতে নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে দখল করার অভিযোগ এনে ৩০ই এপ্রিল ২০১৭ তারিখে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৫ ধারায় মামলা নং ৮১/১৭ করেন দুই ভাই।
মামলার বাদী আশিকুর রহমান বলেন, আনোয়ার হোসেনের জবর দখলের বিরুদ্ধে নিরুপায় হয়ে আদালতে মামলা করি। মামলার তদন্ত করে আশুলিয়া থানা পুলিশ। তদন্তে চাঁন মিয়ার ছেলে আনোয়ার হোসেন জোরপূর্বকভাবে নির্মাণ কাজ করার ও জবর দখল করার পাঁয়তারা করছে এবং আনোয়ার জোরপূর্বকভাবে নির্মাণ কাজ করলে শান্তি শৃঙ্খলা ভঙ্গের আশঙ্কা রয়েছে মর্মে, তৎকালীন আশুলিয়া থানার এসআই ফরাদ একটি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। এই মামলায় আমাদের পক্ষে আদালত রায় দেন। রায় পেয়ে জায়গাটি দক্ষিণ গাজীরচটের মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে আশরাফুল আলমের কাছে বায়না সূত্রে বিক্রি করি। পূর্বের মতো আদালতের রায় অমান্য করে আনোয়ার হোসেন বায়নাকৃত জমির সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলে এবং আশরাফুল আলমকে ভয়-ভীতি ও প্রাণ নাশের হুমকি দেয়। এঘটনাত গত ২৮ আগস্ট ২০২৪ আশুলিয়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন আশরাফুল আলম।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে অভিযুক্ত আনোয়ার হোসেন মুঠোফোনে জানান, ‘আমি যুবলীগের কোন পদে ছিলাম না। আমার ভাই ব্রাদার আত্মীয়-স্বজন রাজনীতি করতো। আমার ফুফাতো ভাই মইনুল ওয়ার্ড মেম্বার। সে যুবলীগের আশুলিয়ার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলো। আমি তার কাছে যেতাম অস্বীকার করার কিছু নাই'। ‘জমির ব্যাপারে ভাই কাগজ ছাড়া কেউ জমি খাইতে পারে না । ২০১০ সালের এই যে ৫০ শতাংশ জমি এখনো ফাঁকা। ওই জমির ব্যাপারে আমরাও মামলা করেছি আদালতে। ওই জমির বিএস আমার নাম থেকে কাইটা গেছে, সেটার উপরেও কেস চলতেছে। এখানে চাঁদাবাজির কোন বিষয় না‘।
২০১১ সালে নূর মোহাম্মদকে গুলি করা ও বোমা মারার ঘটনার বিষয় বলেন, ‘১১সালের হিসাব যদি এখনো করে। ১১ সালে একটা জমি নিয়া মারামারি হইছে, মুরাদ জং আইছিলো এইখানে। ওইখানে আমারে ধরবো কেন ? আশ্চর্য বিষয়। ১১ সালের ঘটনা ঐ মালায় আমারে আসামি করছে। পরে একটা আপস মীমাংসা হইছে। পাশাপাশি বাড়ি এ জায়গায় আমারে মামলা দিছে। আর মামলাও শেষ। তারা নিজেরাই মীমাংসা করেছে। আমার বাসায় আইসা দাওয়াত খায় আমি হেগো বাসায় যাইয়া দাওয়াত খাই‘।
১১ শতাংশ জমির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি এইখানে মার্কেট কইরা বাড়ি কইরা ২০০৯ সাল থেকে ভাড়া দিয়া খাইতেছি । আরেকজন একটা জিন্নুর আইনের দলিল নিয়ে আমার সাথে ঝামেলা করতেছে। আমার বাড়ি দখল করার চেষ্টাও করেছে এটা সবাই স্বাক্ষি আছে‘।
সাইনবোর্ড ভাঙচুরের অভিযোগের বিষয়ে আশুলিয়া থানার এসআই মোতালেব বলেন, গত দুইদিন আগে আশরাফুল আলম নামে একজন অভিযোগ করেছে। আমি অভিযোগের ভিত্তিতে আনোয়ারের সাথে প্রাথমিকভাবে ফোনে কথা বলেছিলাম। আনোয়ার হোসেন বলেছে জায়গাটির উপরে আদালত থেকে ১৪৫ জারি করা আছে। তবে আমি ঘটনাস্থলে যায়নি এখনো। তদন্তে গেলে পুরো বিষয়টি জেনে বলতে পারবো বলেও জানান তিনি।